সোভিয়েত সমাজতন্ত্র : সংবিধান, রাষ্ট্র কাঠামো ও বিচার ব্যবস্থা (খসড়া)

 

leninconstitution

 

অসিত ভট্টাচার্য

১ম ভাগ   — সংবিধান : ১ম /২য়/৩য়

             — সোভিয়েত নেতৃত্বের দৃষ্টিতে কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা

 

২য় ভাগ   — রাষ্ট্র কাঠামো

             — সুপ্রীম সোভিয়েতসোভিয়েত রিপাবলিক

             — অটোনোমাস রিপাবলিকঅটোনোমাস রিজিয়ন

             — ন্যাশনাল এরিয়ানির্বাচন পদ্ধতি

৩য় ভাগ   — বিচার ব্যবস্থা

[সমাজবাদ-সাম্যবাদের প্রশ্নে যে পর্যালোচনা ও চর্চা চলছে, তাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সহায়ক পাঠ হিসাবে এই লেখা। এতে বর্তমান কালের গবেষক-সমালোচক বা তাত্ত্বিকদের মতামতের বদলে লেনিন-স্তালিন সিদ্ধান্ত নেবার আগে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ঘটনাগুলিকে কিভাবে দেখেছিলেন তার উদ্ধৃতিই মূলতঃ দেওয়া হয়েছে। তাতে অবশ্য রচনাটি উদ্ধৃতি বহুল হয়ে পড়েছে। এমনকি খাপছাড়াও হয়তো হয়ে গিয়েছে। তাতে পরিপূর্ণ উপলব্ধি হয় না। তাই উৎসাহী পাঠকের কাছে অনুরোধ, বিতর্ক আলোচনা চলুক— মার্কসবাদী শিক্ষকদের রচনা থেকেই তাঁদের ভাবনা চিন্তাকে বুঝে মূল্যায়ন ও প্রয়োজনে, পুনমর্ূল্যায়ন করি— .বি. আচার্য*]

১ম ভাগ

সংবিধান

যে শ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করে তা বজায় রেখেছে সেই শ্রেণীর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হলো আইন (Law)। আর একটি দেশের সংবিধান হলো সেই দেশের মৌলিক আইন। তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধান বিষয়ক আলোচনা শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে।

বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় মোট তিনটি সংবিধান রচিত হয়েছিল, তারপর ১৯৭৭ সালে ‘ব্রেজনেভ’ সংবিধান বলে পরিচিত সংবিধানটি সমাজতান্ত্রিক সারমর্ম বাদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের সমতুল্য হয়ে ওঠে। আর ইয়েলিৎসিনের আমলে তো সোভিয়েত ইউনিয়নই তুলে দেওয়া হয়।

১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবের পরে পরেই প্রথম সোভিয়েত সংবিধান গৃহীত হয় ১০ই জুলাই ১৯১৮ সালে। লেনিনের তত্ত্বাবধানে রচিত এই সংবিধান সোভিয়েত সমূহের পঞ্চম সারা-রাশিয়া কংগ্রেসে (Fifth All-Russian Congress of Soviets) গৃহীত হয়। এই সংবিধানের মধ্য দিয়ে সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সোভিয়েত সমূহের হাতে হস্তান্তরিত হয়, দেশের অধিবাসী সমস্ত নাগরিকের সমান অধিকার দেওয়া হয়। দেশের সব জমি, বন, জল ও প্রাকৃতিক সম্পদ সকল মানুষের সাধারণ সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়, শ্রমিক ও কৃষকের রাষ্ট্রের হাতে ব্যাঙ্কগুলিকে তুলে দেওয়া হয়। শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি উদ্যোগ সমূহের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ জারী করা হয়। এই সংবিধানে সোভিয়েত শক্তির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সংস্থার বিবরণও দেওয়া হয়। কিন্তু এই সংবিধানও যে শেষ ও পূর্ণাঙ্গ নয় তা সোভিয়েত ডেপুটিদের সামনে লেনিন পরিষ্কার করে খুলে বলেন। বই পড়ার জ্ঞান দিয়ে নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রকে বোঝার উপর তিনি জোর দেন। আর সেই কারণেই, আশ্চর্য মনে হলেও এটা সত্য যে ১৯১৮ সালের এই প্রথম সংবিধানে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার (Socialist system) প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়নি। কারণ লেনিন বললেন— ‘‘আমরা এখনও সমাজতন্ত্রকে এমনভাবে জেনে উঠতে পারিনি যাতে সেটাকে ধারা ও অনুচ্ছেদ দিয়ে গ্রন্থিত করতে পারি— ‘‘we do not yet know a socialism that can be embodied in clauses and paragraphs)’’।

সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় সংবিধান গৃহীত হয় ১৯২৪ সালের জানুয়ারী মাসে সোভিয়েত সমূহের দ্বিতীয় সারা ইউনিয়ন কংগ্রেসে (2nd All-Union Congress of Soviets)। এর আগে ১৯২২ সালে তৈরী হয়েছে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত স্যোসালিস্ট রিপাবলিকস— Union of Soviet Socialist Republics-USSR বা চলতি সোভিয়েত  ইউনিয়ন। তখন এই ইউনিয়নে ছিল মোট ছয়টি সোভিয়েত স্যোসালিস্ট রিপাবলিক। পরবর্তীকালে আরো দশটি (উজবেক, কাজাক, লিথুয়ানিয়ান, মলদেবিয়ান, লাতভিয়ান, কিরগিজ, তাজিক, তার্কমেন, এস্তোনিয়ান এবং কারলো-ফিনিশ) সোভিয়েত স্যোসালিস্ট রিপাবলিকগুলি অন্তভর্ুক্ত হয়। তাছাড়া যুক্ত হয় ১৬টি অটোনোমাস সোভিয়েত স্যোসালিস্ট রিপাবলিক [Autonomous Soviet Socialist Republics], অটোনোমাস রিজিয়ন’ [Autonomus Regions] এবং ন্যাশনাল এরিয়া [National Area]।

যাই হোক ১৯২২ সালে যে USSR বা সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হলো তার জন্য একটা সংবিধান দরকার হয়ে পড়ে। যেখানে সোভিয়েত শক্তির যুক্তরাষ্ট্রীয়বাদের চরিত্র [Federative charactar] বজায় রেখে রাষ্ট্রশক্তির ও প্রশাসনের নতুন এবং সারা-ইউনিয়ন চরিত্র বিশিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা তৈরী করা যাবে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত সমাজতন্ত্র গড়ে উঠছে, সমাজতন্ত্র শ্রমিক কৃষকের প্রাত্যহিক জীবনের বিষয় হয়ে ওঠেনি। তাই দ্বিতীয় সংবিধানেও কোন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উল্লেখ ছিল না।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে নতুন সমাজ গঠনের উল্লেখ পাওয়া যায় তৃতীয় সংবিধানে। এটি ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে USSR-এর সোভিয়েতগুলির বিশেষ অষ্টম কংগ্রেসে [Extra-ordinary Eight Congress of Soviets of USSR] গৃহীত হয়। তার আগে ৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩৫ সালে সোভিয়েতগুলির সপ্তম কংগ্রেসে নতুন সংবিধানের খসড়া নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্তালিনের নেতৃত্বে ৩১ জন সদস্য বিশিষ্ট এক বিশেষ সংবিধান সভার হাতে। এই সংবিধানের রচনা ও গ্রহণ পদ্ধতি এক চমৎকার প্রক্রিয়ায় ঘটে। যার জন্য আজও গোটা বিশ্ব, এমনকি পাশ্চাত্য জগতেও বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলে বিবেচিত। এটি সাধারণভাবে স্তালিন সংবিধান বলেও পরিচিত। এটি পরবর্তীকালে বাতিল হয় ব্রেজনেভ সংবিধান দ্বারা। যাই হোক, ১৯৩৬ সালের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিত হিসাবে বলা হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের বিজয়। প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯২৮-৩৭) মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অকল্পনীয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। শিল্প ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা, যৌথ খামারের বিজয়, উৎপাদনের হাতিয়ারের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে [দু’ধরনের সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি সৃষ্টি হয়েছে— (১) রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি (State property) এবং (২) সমবায় ও যৌথ খামারের সম্পত্তি (Co-operative and collective form of property)]। এই বছরগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রেণী সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। দৃশ্যতঃ কলে-কারখানায় বা কৃষিক্ষেত্রে শোষকশ্রেণীর অস্তিত্ব নেই। মানুষের দ্বারা মানুষকে শোষণ করার কোনো বাহ্য উদাহরণ নেই। শ্রমিক, কৃষক ও বুদ্ধিজীবীদের অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। দেশে বিভিন্ন জাতি সমূহের মধ্যে প্রকৃত সখ্যতা, সম্প্রীতি ও সংহতি দৃঢ় হয়েছে। এমনকি বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া ও নানা ধরনের যে সমস্ত সুবিধাবাদী চক্র এখানে ওখানে বাধা সৃষ্টি করছিল তারাও সম্পূর্ণ রকম পর্যুদস্ত। অবস্থা এরকমই যে মনে হচ্ছিল ১৯১৯ সালের মে দিবসে মস্কোর রেড স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে লেনিন যে কথা বলেছিলেন, তা যেন মধ্য ত্রিশেই লাভ করা গিয়েছে— ‘‘আমাদের দেশের নাতি-নাতনিরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যুগের দলিল-দস্তাবেজ আর স্মৃতিচিহ্নগুলি বিস্ময়ের সঙ্গে গবেষণা করবে। কিভাবে একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবসা ব্যক্তি মালিকানায় থাকতে পারে, কি করে কল-কারখানাগুলি ব্যক্তি মালিকের অধীন হতে পারে, কিভাবে কিছু লোক অন্যদের শোষণ করতে পারে, কোনো কাজ না করে কিভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব— এ সব কিছুর চিত্রকল্প করতে তাদের কষ্ট হবে। বাস্তবিকই দেশের ছবিটা  ছিল অকল্পনীয়, অভাবিত, দারুণ! (এ ছবিটা আজকের সমালোচকদের লেখায় ঠিকমতো ফুটে ওঠে না। কিন্তু তখন যে কোন লেখায়— তা নিন্দা সূচক বা প্রশংসাসূচক প্রবন্ধ হোক, চিঠি হোক, ইন্টারভ্যু হোক, বিশ্ব ঘটনার যে কোন আলোচনা হোক, প্রত্যেকটিতে এই অনুভূতির ছাপ পাওয়া যায়)। পনেরো কুড়ি বছর আগেও যে শ্রমজীবী মানুষ ছিল দেশে উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, তারাই আজ কি অর্থনীতি, কি রাজনীতি আর কিবা সামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের মালিকানা ভোগ করছে। এটা যদি পূর্ব অভিজ্ঞতাহীন সমাজতন্ত্রকে একটু বাড়িয়ে দেখার দোষ হয় সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। বাস্তবিক পক্ষে পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যে এরকমই একটা সন্তোষজনক ছবি দেখা দিয়েছে। যেন দেশের ভিতরটা সব ঠিকঠাক আছে। বিপদটা আর অভ্যন্তরে নয়— বহির্দেশে এবং সেখান থেকে আরোপিত কিছু এজেন্ট মারফৎ। এমনকি এরকম একটা বক্তব্য স্বয়ং জে.ভি.স্তালিনের কাছ থেকে এসেছে বলে অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে ১৯৩৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তারিখে খসড়া সংবিধান পেশ করতে গিয়ে ইউ.এস.এস.আর-এর সোভিয়েত সমূহের বিশেষ অষ্টম কংগ্রেসে স্তালিনের বক্তৃতা এবং তাঁর লেখা ‘লেনিনবাদের সমস্যাবলি’ (Problems of Leninism) নামক বইটার উল্লেখ করা হয়।

খসড়া উপস্থাপনায় তিনি বলছেন— ‘‘এইভাবে জাতীয় অর্থনীতির সমস্ত স্তরে এখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিজয় হলো বাস্তব ঘটনা। এর অর্থ কি?

এর মানে হলো মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের শোষণ লোপ পেয়েছে, দূর করা গেছে, আর উৎপাদনের মাধ্যম ও হাতিয়ার সমূহের উপর সমাজতান্ত্রিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাতে সোভিয়েত সমাজ অকম্পিত ভিত্তির উপর দাঁড়ায়।… ‘‘১৯২৪ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রধানতঃ এইসব পরিবর্তন ঘটেছে।

‘‘সোভিয়েত ইউনিয়নের (ইউ.এস.এস.আর-য়ের) অর্থনীতিতে এই পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুয্য রেখে আমাদের সমাজে শ্রেণী কাঠামোরও পরিবর্তন এসেছে।

‘‘গৃহযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির ফলে জমিদার শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটেছে। অন্যান্য শোষক শ্রেণীর ভাগ্যেও জমিদার শ্রেণীর দশা ঘটেছে। শিল্পক্ষেত্রে পুঁজিপতি শ্রেণী শেষ হয়ে গিয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে কুলাক শ্রেণী শেষ হয়ে গিয়েছে। এবং ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোররা শেষ হয়ে গিয়েছে। এইভাবে সমস্ত শোষক শ্রেণীগুলি নিমর্ূল হয়ে গিয়েছে।

 ‘‘এখন রয়েছে শ্রমিক শ্রেণী।

 এখন রয়েছে কৃষক শ্রেণী।

 এখন রয়েছে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়।’’

কমরেড স্তালিনের এই বক্তব্যের মধ্যে আমরা দেখছি ১৯৩৬ সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নে শোষক শ্রেণীগুলি নেই— আছে অন্যান্য শ্রেণী যাদের মধ্যে বেশ বড় রকম গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে (এটা উপরোক্ত উদ্ধৃতির পরে বলেছেন) এবং এদের মধ্যেকার সম্পর্কতো বটেই এমনকি বিভিন্ন বৈরীমূলক জাতিগুলির মধ্যেকার সম্পর্কও সুমধুর মৈত্রীমূলক হয়ে উঠেছে (এটাও বক্তৃতায় বিশদভাবে দেখিয়েছেন)। তা এই বক্তব্য কি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী ভুল? সমাজতন্ত্রে একাধিক শ্রেণীর অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু শোষক-শোষিতের সম্পর্ক নেই, এমন কথা কি মার্কসবাদ বিরোধী? দেখা  যাক— কমরেড মাও সে তুঙ তাঁর ‘দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে’ (On Contradiction) প্রবন্ধের ‘দ্বন্দ্বে বৈরিতার স্থান’ পরিচ্ছেদে বলেছেন,— ‘‘আমাদের জবাব হচ্ছে : বৈরিতা বিপরীত সংগ্রামের একটা রূপ, কিন্তু একমাত্র রূপ নয়।

‘‘মানব ইতিহাসে শ্রেণী বৈরিতা থাকে বিপরীতগুলোর সংগ্রামের একটি বিশেষ প্রকাশরূপে। শোষক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণীর মধ্যেকার দ্বন্দ্বের কথা বিবেচনা করুন। এইসব দ্বন্দ্বমান শ্রেণীগুলি বহুদিন একই সমাজে সহ-অবস্থান করে সে সমাজ দাসসমাজ, সামন্তসমাজ বা ধনতান্ত্রিক সমাজ যাই হোক না কেন এবং তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, কিন্তু শ্রেণী দুটির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব একটা নির্দিষ্ট স্তরে উন্নীত হওয়ার পরই কেবল প্রকাশ্য বৈরিতার রূপ নেয় এবং বিপ্লবে পরিণত হয়।…’’

তারপর শেষে লেনিনের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন— ‘‘বৈরিতা ও দ্বন্দ্ব মোটেই এক ও অভিন্ন নয়। সমাজতন্ত্রের অধীনে, প্রথমটার বিলুপ্তি ঘটবে, কিন্তু দ্বিতীয়টা থাকবে।’’ তার পর নিজের বক্তব্যে বলছেন,— ‘‘অর্থাৎ বৈরিতা হচ্ছে বিপরীতগুলির সংগ্রামের একটা রূপ, কিন্তু একমাত্র রূপ নয়, বৈরিতার সূত্রকে সর্বত্র নির্বিচারে প্রয়োগ করা যায় না।’’

এরপর তার প্রবন্ধ ‘‘জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসার সমস্যা প্রসঙ্গে’’ (On the Correct Handling of Contradictions Among the People) আমরা দেখছি তিনি বলছেন, ‘‘সমাজতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্বগুলি পুরোনা সমাজের যথা— ধনতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্বগুলি থেকে মূলগতভাবে পৃথক। ধনতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্বগুলি প্রচণ্ড বৈরিতা ও সংঘাত এবং তীব্র শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রকাশ পায়। এ দ্বন্দ্বের সমাধান ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারা হতে পারে না, সমাধান হতে পারে শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বারা। পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্ব ঠিক এর উল্টো, সে দ্বন্দ্বগুলি বৈরিতামূলক নয় এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারাই অবিরামভাবে সেগুলির সমাধান হতে পারে।’’

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ধনতান্ত্রিক সমাজের পরস্পর বৈরীমূলক সম্পর্কের  দুটি শ্রেণী— শোষক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণীর  সম্পর্কের অবসান ঘটে সমাজতান্ত্রিক সমাজে। আর সমাজতান্ত্রিক সমাজে যেসব শ্রেণী থাকে তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক বৈরীমূলক নয়, তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব লাগাতার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সমাধিত হয়। কমরেড স্তালিনের উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে কি একথার বিরোধ আছে? ১৯৩৪ সালে সি.পি.এস.ইউ.(বি)-র সপ্তদশ কংগ্রেসে দেওয়া তাঁর রিপোর্টে যে বিবরণ পাচ্ছি১০ ১৯৩৬ সালের সংবিধান পেশ করতে মুখবন্ধ বক্তৃতাতেও তারই অগ্রগতির বিবরণ পাচ্ছি— শোষক শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই, আছে (অবৈরীমূলক) বিভিন্ন মিত্রশ্রেণীগুলি, যারা এক নতুন স্তরে উন্নত হয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই পথই তো লেনিনের নির্দেশিত ও মাও সে তুঙ সমর্থিত। তাহলে স্তালিনের এই বক্তৃতাটা মার্কসবাদীদের দ্বারা সমালোচিত কেন? আজ যারা এক কথায় ‘ভুল’ ধরছেন, তাদের বলতে হবে ভুলটা কার, কোথায়?

তবে আশ্চর্যের বিষয়ের হলেও একথা স্বীকার করতে হবে যে ১৯৩৪ সালে সপ্তদশ কংগ্রেসে ‘এক শ্রেণীহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ’ গঠনের বাস্তবতাকে যেভাবে দেখেছিলেন, পাঁচবছর পরে অর্থাৎ ১৯৩৯ সালে স্তালিন তার থেকে বেশ খানিকটা সরে গিয়েছেন। ঐ বছর মার্চে সি.পি.এস.ইউ (বি)-র অষ্টাদশ কংগ্রেসে তাঁর রিপোর্টে তিনি অূোবর বিপ্লবের পর থেকে দুটি স্তরের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম স্তরটি ছিল অূোবর বিপ্লব থেকে শোষক শ্রেণী সমূহের উচ্ছেদের কাল পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় স্তরটি ছিল গ্রাম-নগরে মূল ধনতান্ত্রিক উপাদানগুলির উচ্ছেদ থেকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পূর্ণ বিজয় এবং নতুন সংবিধান গ্রহণের সময় পর্যন্ত। ‘‘দেখতেই পাচ্ছেন যে এখন আমাদের রয়েছে এক সম্পূর্ণ নতুন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ইতিহাসে যার কোনো নজীর নেই। আর এটি প্রথম স্তরের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ ও কর্তব্য পালনের দিক দিয়ে অনেকখানি ভিন্ন।’’*

কিন্তু সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সংকট বা পতন সম্পর্কে এ রকম ত্রুটি বা দুর্বলতা, মনে হয়, খুব বড় কারণ হিসাবে দেখার দরকার নেই। যতটা দেখা দরকার মাও সে তুঙ বর্ণিত সমাধানসূত্র পালনের প্রশ্নে অর্থাৎ ‘‘সমাজতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্ব ঠিক এর উল্টো। সে দ্বন্দ্বগুলি বৈরীতামূলক নয়, এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারাই অবিরামভাবে সেগুলির সমাধান হতে পারে।’’ (জোর আমার)

প্রকৃতপক্ষে একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাভিত্তিক বিধিবদ্ধ ধারা সম্বলিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্র কতদিন ছিল? ১৯৩৬ সাল থেকে বড়জোর ব্রেজনেভ সংবিধান রচনা পর্যন্ত (১৯৭৭)। যার মধ্যে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রায় সর্বস্বান্ত হওয়া প্রচণ্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চাপ প্রতিহত করা, স্তালিনের মৃত্যু এবং তারপরই ধুন্ধুমার রবে ক্রুশ্চেভ ও অন্যান্য সংশোধনবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ। তাহলে ধরতে হবে, খুব বেশী হলে যুদ্ধপূর্ব বছর তিন-চার সময় ছিল যখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে অবৈরীমূলক দ্বন্দ্বগুলিকে সমাধান করা যেতে পারত। এই সময়কে অবশ্যই ‘অবিরাম’ (Ceaselessly) নামে চিহ্নিত করা যায় না! বরং এর থেকে চীনা সমাজতন্ত্রের দিকেই আমাদের বিশেষ নজর দেওয়ার দরকার। কারণ তাঁদের সামনে পূর্বসূরী হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা ছিল, দুর্বলতা / ত্রুটি (যতটা ছিল, সবটা) তাঁরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, সময়ও পেয়েছিলেন (যদিও এই সময়ের মধ্যেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিশাল কর্মসূচী এসে পড়ে)। তা সত্ত্বেও চীনা সমাজতন্ত্রের পতন কেন হলো?

এ প্রসঙ্গে, মনে হয়, দ্বন্দ্ব (Contradiction) এবং বৈরিতা (Antagonism)— এই দুটি বিষয়কে আবার ভালোভাবে দেখা দরকার— বিশেষ করে দুটি সমাজতন্ত্রের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে বৈরীমূলক হয়ে গেছে। এবং তা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন দুটি দেশেই শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতন্ত্রকে পরাজিত করে পুঁজিবাদী রাস্তায় প্রতিস্থাপিত করেছে। ইতিহাসের বস্তুগত ঘটনাবলি যে বিপুল শক্তিতে মানুষের চেতনার স্তরকে ছাপিয়ে তাকে পুনশ্চিন্তায় বাধ্য করে, এটা স্বীকার করতে হবে।

যাই হোক, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক জীবনে স্তালিন সংবিধান সোভিয়েত শ্রমজীবী জনগণকে দিয়েছিল পূর্ণ গণতন্ত্র— অবশ্য এক্ষেত্রেও কালের সীমাবদ্ধতা কেউ অস্বীকার করবে না। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল একদিকে চরম শক্তিশালী এবং একই সাথে গণতান্ত্রিক। এটি যে চরম শক্তিশালী এবং কেন্দ্রিকতা সম্পন্ন ছিল তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তীকালে। আর এর পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপটি বাস্তবে কেমন ছিল, কেমন তার প্রয়োগগত বন্দোবস্ত (mechanism) ছিল, তা আমরা এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আলোচনা করবো। তবে এটা প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে এই গণতন্ত্রের ধারণাটি বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে ধারণা উপস্থিত করেছে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে এখন আর গণ বা গ্রীক শব্দ Demo-র কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা এখন মূলতঃ ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক ব্যক্তি স্বাধীনতার সমতুল্য হয়ে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র বিরোধী হয়ে উঠেছে। এভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শ কেবলমাত্র ভোটাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে হাজির করে সবচেয়ে বেশী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে— বিশেষ করে পেটি বুর্জোয়াদের মধ্যে। আর তার ফাঁক দিয়ে ব্যক্তি প্রাধ্যান্য ও ব্যক্তি উদ্যোগে বিশ্বাসী বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদের পক্ষে অনুকূল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অপরদিকে, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্রের আদর্শনীতি হলো— হ্যাঁ, প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্রের মধ্যেই এবং তার এক বিশেষ অঙ্গ হিসাবেই— গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা ও উৎপাদন পরিকল্পনায় শ্রমজীবী জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। দেশের বৈষয়িক জীবন নিয়ন্ত্রণে সংখ্যাগরিষ্ঠর সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রলেতারীয় পথ গ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের গণতন্ত্র যে সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র হয় না তা লেনিন, স্তালিন বা সোভিয়েত নেতৃত্বের বুঝতে অসুবিধা হয়নি।১১ তাই গণতন্ত্রকে বা প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্রকে বুঝতে হলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষ কিভাবে এবং কতটা গণতন্ত্র ভোগ করেছিল, সেটা স্তালিন-সংবিধান পাঠ করার সময় খেয়াল রাখা দরকার। আবার শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী শ্রেণীসংগ্রামে, কেবলমাত্র মার্কস-এঙ্গেলসের নিভর্ুল সাধারণ তত্ত্বের ভিত্তিতে নয়, উপরন্তু বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রেখেই শ্রেণীর একনায়কত্ব কি কি বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে এবং তা বাস্তবে, প্রয়োগ করতে হলে কি পদ্ধতি, কোন কোন ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে এগুতে হবে সেটাও জানা দরকার। বাস্তবে যা ঘটেছিল তার তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে লেনিন স্তালিন বা সোভিয়েত নেতৃবর্গের মতামত এক ঝলকে দেখা যাক।

প্রথমে একটা সাবধানতার কথা বলা দরকার। আজ আমরা বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্রের রাজত্বে, এমনকি শ্রেণী সংগ্রামের নীচু অবস্থার সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের রাজনৈতিক জীবন মূলতঃ শান্তিপূর্ণ আইনী আবহাওয়ায় ঘরোয়া মিটিং রচনা পাঠ ও লেখা ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ। তাই বাস্তবে এক অশান্ত সময়ে হিংস্র শ্রেণীসংগ্রামের বাতাবরণে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্রকে বুঝতে আজ একটু কষ্ট হবে, তা স্বীকার করা ভাল। এ প্রসঙ্গে যত লেখাপড়া সম্ভব তা পড়া দরকার।

লেনিন তার প্রবন্ধ কন্ট্রিবিউসন টু দ্য হিষ্ট্রি অব দ্য কোয়েশ্চেন অব দ্য ডিকটেটরশিপ প্রবন্ধে (১৯২০) বলেছেন, ‘‘আইন বা বিধিনিষেধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে এবং সরাসরি বল প্রয়োগের উপর নির্ভর করে অবাধ ক্ষমতাই হলো একনায়কতন্ত্র বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ধারণা, তার থেকে কম-বেশী কিছুই নয়।’’১২ তাঁর দ্বিতীয় মতামত পাচ্ছি অন ডিসীবিং দ্য পিপল উইথ স্লোগানস এ্যবাউট লিবার্টি এ্যন্ড ইকোয়ালিটি নামে বক্তৃতা প্রকাশের মুখবন্ধে। ‘‘প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র মানে শ্রেণী সংগ্রামের অবসান নয়; বরং নতুনরূপে তার ধারাবাহিকতা। প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র হলো বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী সংগ্রামের বিজয় লাভ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল— যদিও বুর্জোয়ারা পরাজিত হয়েছে, কিন্তু নিমর্ূল হয়নি, অদৃশ্য হয়ে যায়নি, তারা প্রতিরোধ বন্ধ করেনি, প্রতিবন্ধকতা বাড়িয়েই যাচ্ছে।’’১৩ তিনি ঐ লেখায় আরো বললেন, ‘‘প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র হলো শ্রমজীবী জনগণের অগ্রণী বাহিনী হিসাবে প্রলেতারিয়েত এবং (পেটি বুর্জোয়া, ছোট মালিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ইত্যাদির মতন) শ্রমজীবী জনগণের অসংখ্য অ-প্রলেতারিয় স্তরের অথবা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যেকার শ্রেণীমৈত্রীর এক বিশেষ রূপ; এটি পুঁজির বিরুদ্ধে একটা জোট, পুঁজির সম্পূর্ণ উৎখাতের লক্ষ্যে বুর্জোয়াদের প্রতিরোধকে বা তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোন প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণভাবে দাবিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে তৈরী একটা জোট; এটি হলো সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা ও সংহতি আনার লক্ষ্যে এক মৈত্রী। এটি এক হিংস্র গৃহযুদ্ধের মতন বিশেষ পরিস্থিতিতে গড়ে ওঠা এক বিশেষ ধরনের মৈত্রী; এটি  সমাজতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থকদের সাথে সমাজতন্ত্রের দোদুল্যমান মিত্রদের মৈত্রী এবং কখনো কখনো ‘নিরপেক্ষ’দেরও (যখন সংগ্রামের মতৈক্যের বদলে নিরপেক্ষতার মতৈক্য গড়ে ওঠে)। এটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং মতাদর্শগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীদের মধ্যেকার মৈত্রী।’’১৪

তারপরের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানালের তৃতীয় কংগ্রেসে () আর.সি.পি কর্তব্য প্রসঙ্গ রিপোর্ট করতে গিয়ে। ‘‘একনায়কতন্ত্রের সবের্াচ্চ নীতি হলো প্রলেতারয়িত ও কৃষকদের মধ্যেকার মৈত্রীকে রক্ষা করা যাতে প্রলেতারিয়েত তার নেতৃত্বদায়ী ও রাষ্ট্রক্ষমতা বজায় রাখতে পারে।’’১৫

লেনিনের দেখানো বৈশিষ্ট্যগুলির উপরই ভিত্তি করে স্তালিন সংক্ষেপে বললেন, ‘‘তাই প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্রের তিনটি দিক রয়েছে—

(১) শোষকদের দমন করার জন্য, দেশের প্রতিরক্ষার জন্য, অন্য দেশের প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে ঐক্যবন্ধন গড়ে তোলার জন্য, এবং সবদেশে বিপ্লবের অগ্রগতি ও বিজয়ের জন্য প্রলেতারিয়েতের শাসন ব্যবস্থাকে সদ্ব্যবহার করা;

(২) মেহনতি ও শোষিত জনতাকে বুজের্ায়াদের সম্পর্ক থেকে একেবারে মুক্ত করতে, এই জনতার সাথে প্রলেতারিয়েতের মৈত্রীবন্ধন রচনা করতে, সমাজতান্ত্রিক গঠন ক্রিয়ায় এই জনতাকে টেনে আনতে এবং প্রলেতারিয়েতের সাহায্যে এই জনতার রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে প্রলেতারিয়েতের শাসন ব্যবস্থাকে সদ্ব্যবহার করা;

(৩) সমাজতন্ত্রের সংগঠনের জন্য, শ্রেণীসমূহ বিলোপ করার জন্য, শ্রেণীহীন এক সমাজে, সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণের জন্য প্রলেতারিয়েতের শাসন ব্যবস্থাকে সদ্ব্যবহার করা।

প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র হলো এই তিনটি দিকেরই সমাহার। এর কোন একটিকে প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্য বলে পেশ করা যায় না।’’১৬

প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলি দেখার পর আমরা আসবো বাস্তবে কিভাবে এই একনায়কতন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে  শ্রমিকশ্রেণী প্রয়োগ করতে পারে। তার সাংবিধানিক আইনগত দিক কি কি সে সম্পর্কে সোভিয়েত নেতৃত্বের ভাবনা কি ছিল সেটা জানতে। কিন্তু তার আগে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে রয়েছে। সেটি হলো পার্টি ও শ্রেণীর মধ্যেকার সম্পর্ক বা সমাজতন্ত্রে কমিউনিস্ট পার্টি বা/এবং একাধিক অন্য পার্টির সাংবিধানিক অস্তিত্ব বা অধিকার দেওয়া হবে কিনা— এই  ধরনের প্রশ্ন।

এ কথা প্রায় সবাই জানেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনে (এবং সেইদিক দিয়ে অন্যান্য যে কোন সমাজতান্ত্রিক দেশে) শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবোত্তর যুগে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকলেও তাদের বা তাদের বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক দল বজায় রাখার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে পার্থক্য রয়েছে। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই অধিকার না দিলেও চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও একাধিক পার্টি ছিল, রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মাও সে তুঙ তাঁর দশটি প্রধান সম্পর্ক প্রসঙ্গে (এপ্রিল ১৯৫৬) বলছেন,

‘‘কোনটা ভালো?— একটা পার্টি থাকা, না অনেকগুলো পার্টি থাকা? এখন আমরা যা দেখছি, তাতে মনে হয় অনেকগুলো পার্টি থাকা ভালো। অতীতেও এর ফল ভালো হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও সম্ভবত ভালো হবে; এর জন্য পার্টিগুলোর দীর্ঘস্থায়ী সহাবস্থান ও পারস্পরিক তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন।

 ‘‘জাপবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধ ও চিয়াং কাইশেকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময়ে আমাদের দেশে মূলতঃ জাতীয় বুর্জোয়া এবং ঐ শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত অনেকগুলি গণতান্ত্রিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করে, আর সেগুলি আজও রয়ে গেছে। এই দিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চীনের পার্থক্য আছে। আমরা ইচ্ছে করেই এই গণতান্ত্রিক পার্টিগুলিকে থাকতে দিয়েছি, তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছি এবং তাদের প্রতি ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি অনুসরণ করেছি। ….

 ‘‘যেহেতু চীনে এখনও শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রাম রয়েছে, সে ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে বিরোধী পক্ষ থাকতে বাধ্য। যদিও সমস্ত গণতান্ত্রিক দলগুলি ও নির্দল গণতন্ত্রীরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁদের মধ্যে অনেকেই কমবেশী বিরোধী পক্ষে। … তাঁরা একটা সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সংবিধান গ্রহণ করতে চাননি। তাঁদের কথায় ‘সাধারণ কর্মসূচীই তো ঠিক আছে;’ অথচ যখন খসড়া সংবিধান প্রকাশিত হলো, তাঁরা সবাই তার সমর্থনে হাত তুললেন। বহু জিনিষই তার বিপরীতে রূপান্তরিত হয় এবং বিভিন্ন প্রশ্নে গণতন্ত্রবাদী বিরোধী পক্ষের মনোভাবের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। তাঁরা বিরোধীপক্ষ আবার বিরোধীপক্ষও নন, অনেক সময়ই বিরোধীপক্ষ হিসাবে শুরু করে শেষে বিরোধী থাকেন না। …

 ‘‘অবশ্য পার্টি ও সরকারি শাসনযন্ত্র ছিমছাম করার অর্থ এই নয় যে গণতান্ত্রিক পার্টিগুলোকে ভাগিয়ে দিতে হবে। আমার মত এই যে, তাদের সাথে সম্পর্কের উন্নতি করতে আমাদের সংযুক্ত মোর্চার কাজে বিশেষ মনোযোগী হওয়া উচিত এবং সমাজতন্ত্রের স্বার্থে তাদের উদ্যম জাগিয়ে তুলতে সম্ভাব্য সবরকম প্রচেষ্টা চালানো উচিত।’’১৭

প্রায় একই রকম বক্তব্য ১৯৫৭ সালের লেখা জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসার সমস্যা প্রসঙ্গে মাও সে তুঙ বলেন।

অপরদিকে রাশিয়ার ইতিহাস, অভিজ্ঞতা এবং সম্ভবত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের পলিসিও আলাদা। প্রাক্-বিপ্লব রাশিয়ায় প্রধানতঃ কোন কোন শ্রেণীকে কোন কোন রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও ঝোঁক প্রতিনিধিত্ব করতো, তা লেনিন-স্তালিনের অনেক লেখায় পাওয়া যায়। তবু নির্দিষ্টভাবে তালিকাভুক্ত করে লেনিন তার প্যামফ্লেট পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন রাশিয়া অ্যান্ড দ্য টাস্ক অব দ্য প্রলেতারিয়তে (এপ্রিল ১৯১৭) এবং পরবর্তীকালে আবার পার্টিজ ইন দ্য পেট্রোগ্রাদ ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল ইলেকসন নামে এক প্রবন্ধ প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশ করেন (দুইই রয়েছে Vol. 24-এ)। রাশিয়ার ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে যে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ‘ব্ল্যাক হান্ড্রেড’ বা বুর্জোয়া ‘ক্যাডেট পার্টি’র বিরুদ্ধেই কেবলমাত্র নয়, শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বলশেভিকদের বারবার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস, সোশ্যাল রেভল্যুশনারীজ (এস.আর.) বা ঐ ধরনের নানা গোষ্ঠির বিরুদ্ধেও তীব্র সংগ্রাম চালাতে হয়েছে— হাঁ, মেনশেভিকদের বিরুদ্ধেও। এপ্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন,

‘‘এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে রাশিয়ায় এই ছোট-কৃষক শ্রেণী (মধ্য কৃষক বলতে আমরা মনে করি তারা যারা নিজ শ্রমশক্তি বিক্রী করে না) হলো পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের মধ্যে নানা বৈচিত্র্যের রাজনৈতিক ঝোঁকের উৎস হিসাবে প্রধান অর্থনৈতিক শ্রেণী। এখানে রাশিয়ায় এইসব ঝোঁকের বেশীর ভাগই মেনশেভিক ও এস.আর. পার্টিগুলির সাথে সম্পর্কিত। রাশিয়ায় সমাজবাদের ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে যে এই পার্টিগুলির বিরুদ্ধে বলশেভিকদের রয়েছে দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। অন্যদিকে, পশ্চিম ইউরোপের সমাজতন্ত্রীদের কাছে এই সংগ্রাম সবসময় সমাজতন্ত্রের ভিতরকার সংগ্রাম, অর্থাৎ রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে ভাঙ্গন হিসাবে। [জোর লেনিনের— লেখক]। …’’

তারপর বলছেন,

‘‘এটি এক খুব জটিল প্রশ্ন যার পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক সম্পদ। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু বলা দরকার। আমাদের চোখের সামনে ঘটে চলা মেনশেভিকদের ও এস.আর.-দের এই পলিসী আমাদের দৃঢ় মতামতকে সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করে দেয় যে তাদেরকে আর সমাজতন্ত্রী বলে গণ্য করা যায় না। যদি তারা কখনো কোনো কালে সমাজতন্ত্রী থাকে, তাহলে তা ছিল কেবলমাত্র বাক্যবিন্যাস ও স্মৃতিচারণার কারণে; প্রকৃতপক্ষে তারা রুশ পেটি-বুর্জোয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। …’’

আর সেক্ষেত্রে অবস্থান ঠিক করতে তিনি বললেন,

‘‘তখন [১৯১৭ সালের অূোবর, নভেম্বর মাসে— লেখক] বলশেভিক পার্টি একেবারে সঠিকভাবে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। আমরা জানিয়েছিলাম যে আমরা প্রলেতারিয়েতের শত্রুদের ধ্বংস করবো, আর তখন আমাদের যুদ্ধ ও শান্তি, বুর্জোয়া প্রতিনিধিত্ব এবং সোভিয়েত সরকারের মতন মূল মূল বিষয়গুলিতে লড়াই-র মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এইসব বিষয়তে আমাদের নিজস্ব শক্তির উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর তাই আমরা একেবারেই সঠিক ছিলাম যখন পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের সাথে আপোষ করতে আমরা অস্বীকার করি।’’১৮

তাহলে চীন বা অন্য দেশে যদি জাতীয় বুর্জোয়া বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে আপোষ করার সাধারণ নীতি ছিল, যার কারণে সংবিধানেও সেই অধিকার পরবর্তীকালে দেওয়া হয়েছিল, রাশিয়ায় ছিল ভিন্ন নীতি। একটু নজর করলেই আমরা দেখতে পাব যে লেনিন, স্তালিন তাদের প্রতিটি লেখায়, বক্তৃতায়, রিপোর্টে, আন্দোলনের কর্মসূচি ব্যাখ্যায় এইসব দল ও তাদের মুখপাত্রদের বিরুদ্ধেও তীব্র আক্রমণ করে তাদের স্বরূপ খুলে দেবার চেষ্টা করছেন। তাহলে রাজনৈতিক দিক দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর সাথে এইসব অপ্রলেতারিয় শ্রমজীবী জনগণের, বিশেষ করে ছোট কৃষকদের সম্পর্ক কেমন হবে, কিভাবে হবে? রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখলের পর ১৯২১ সালের ২৭শে মার্চ সারা-রুশ ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃতায় লেনিন বললেন—

‘‘সোভিয়েত রিপাবলিকে এই সেই শ্রেণী [প্রলেতারিয়েত— লেখক] যে সাড়ে তিন বছর আগে ক্ষমতা তুলে নিয়েছিল, আর তারপর থেকে নিজের আধিপত্য— একনায়কতন্ত্র প্রয়োগ করে যাচ্ছে, এবং অন্য যে কোনো শ্রেণীর থেকে বেশী মাত্রায় নিঃশেষিত, অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিত হবার যন্ত্রণা সহ্য করে যাচ্ছে।’’….

কিন্তু,

‘‘এই শ্রেণী এটা জেনেবুঝেই রাজনৈতিক ক্ষমতা নিল যে এটি তাদের একা একা করতে হবে। এ হলো প্রলেতারিয় একনায়কত্বের সহজাত ধারণা। যখন কোনো শ্রেণী জানে যে, তাকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে এবং অপরকে বা নিজেকেও প্রতারণা করে ‘সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনমতের দ্বারা জনপ্রিয় সরকারের’ কথা বলে না, তখন এর অর্থ পরিষ্কার হবে।’’১৯

এবার আবার পূর্বে উল্লেখ করা লেনিনের মন্তব্যটি বিচার করুন, ‘‘একনায়কতন্ত্রের সর্বোচ্চ নীতি হলো প্রলেতারিয়েত ও কৃষকদের মধ্যেকার মৈত্রীকে রক্ষা করা, যাতে প্রলেতারিয়েত তার নেতৃত্বদায়ী ও রাষ্ট্রক্ষমতা বজায় রাখতে পারে’’ [১৫নং পাদটীকা]। এইভাবে সোভিয়েত নেতৃত্বের মতামত ছিল একটি শ্রেণীর একনায়কত্বে— প্রলেতারিয় একনায়কত্বে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে; এ প্রশ্নে অন্য কোনো শ্রেণীর সাথে আপোষ নেই। এর পিছনে আরও যে যুক্তি ছিল তা সংক্ষেপে এইরকম— যেহেতু পুঁজিবাদের যুগে কৃষক সহ পেটি বুর্জোয়াদের নিজস্ব কোনো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি নেই, তারা হয় বুর্জোয়া অথবা প্রলেতারিয়েত নেতৃত্বে চলে যাবার পথে থাকে, তাই তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি বলে যারা পরিচিত, তারা প্রধানতঃ বুর্জোয়া সরকার দ্বারা মদতপুষ্ট হয়ে শ্রমিকশ্রেণীর বিরোধী শক্তির অংশ। সুতরাং সেই রাজনৈতিক দল ও প্রতিনিধিকে শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং মিত্র শ্রেণীকে শ্রমিক শ্রেণীর প্রভাবাধীন করে প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্রকে দুর্বার করা— এরকমই ছিল সাধারণ পলিসী। তাই কমিউনিস্ট পার্টি ভিন্ন অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি সোভিয়েত নেতৃবর্গ দেননি।

আর এই পলিসীর সুষ্ঠু প্রয়োগ যে প্রয়োজনানুসারে মোটেই অগণতান্ত্রিক নয়— এতে ‘সমাজের সকল বিশেষ স্বার্থগুলি প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না’— তা স্বীকার করেছেন ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রী বলে পরিচিত ইংল্যান্ডের সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব দম্পতি। [এরা শ্রমিকশ্রেণী ও শোষিত মানুষের কল্যাণে আজীবন থেকে গেলেও তাত্ত্বিক দিক দিয়ে মার্কসবাদ ও কমিউনিজম গ্রহণ করেননি।]২০

এবারে আমরা আসবো এ পর্যায়ের শেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে। অ-পার্টি ও পার্টি সদস্য নির্বিশেষে শ্রমিকশ্রেণীর গোটা অংশটাই কিভাবে প্রলেতারিয় একনায়কত্ব প্রয়োগ করতে পারে, কি তার বন্দোবস্ত— সে সম্পর্কে রুশ নেতৃবর্গের ধারণা কি ছিল, তা জানার চেষ্টা করবো।

প্রথম বিষয় : শ্রেণী ও পার্টি। লেনিন বলছেন,

‘‘পুঁজিবাদে এটা বাস্তব যে শ্রমিক জনতা অনবরত শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয় এবং নিজেদের মানবিক যোগ্যতার বিকাশ সাধন করতে পারে না, তখন শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলির সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হলো যে সেগুলি কেবলমাত্র স্বীয় শ্রেণীর সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশকে নিয়ে গড়ে ওঠে। যে কোন পুঁজিবাদী সমাজে যেমন করে সমস্ত শ্রমিকদের এক সংখ্যালঘু অংশ প্রকৃতপক্ষে শ্রেণী সচেতন শ্রমিক হিসাবে গড়ে ওঠে, ঠিক তেমনি … একটি শ্রেণীর সংখ্যালঘষ্ঠি অংশও একটি রাজনৈতিক দল গড়তে পারে। তাই আমাদের স্বীকার করতে হবে যে এই শ্রেণী সচেতন সংখ্যালঘু অংশ ব্যাপক শ্রমিক জনতাকে নির্দেশ ও নেতৃত্ব দিতে পারে। … এই সংগঠিত সংখ্যালঘিষ্ঠটি কি? যদি এই সংখ্যালঘু অংশটি প্রকৃতপক্ষে শ্রেণী সচেতন হয়, যদি জনসাধারণকে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়, যদি দৈনন্দিন কর্মসূচির প্রতিটি প্রশ্নের জবাব তৈরি করতে পারে, তাহলে সেটাই প্রকৃতপক্ষে পার্টি।’’২১

স্তালিন এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সোভিয়েতগুলি ও অন্যান্য গণসংগঠনগুলি যাতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে, তার জন্য পার্টির নেতৃত্বদায়ী নির্ধারক ভূমিকার দিক দিয়ে দেখে ‘প্রলেতারিয়তের একনায়কতন্ত্র’ এবং ‘পার্টির একনায়কতন্ত্র’কে লেনিন মূলতঃ (in essence) এক বলেছিলেন, সেটা স্বীকার করে নিয়েও পার্টির নির্দেশ অনুযায়ী প্রলেতারীয় একনায়কত্বের সবকিছু চালাতে হবে, এই তত্ত্বের তীব্র বিরোধ করতেন। তাঁর মতে প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্রে পার্টির পরিচালন-নির্দেশাবলী ছাড়াও থাকে প্রলেতারিত গণসংগঠনগুলি কিভাবে তাকে প্রয়োগ করবে, থাকে সমগ্র জনসাধারণ কিভাবে সেই কর্মসূচী সুসম্পন্ন করবে সেই প্রশ্নগুলি। তাই দুটি বিষয়কে গুলিয়ে একাকার করে দেবার ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধিতা করে তিনি বললেন, ‘‘নমুনা হিসাবে দেখুন, সোরিন বলছেন, প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র মানে হলো আমাদের পার্টির একনায়কতন্ত্র২২ এই তত্ত্ব পার্টির একনায়কত্বের সাথে প্রলেতারিয় একনায়কত্বকে একাকার করে দিচ্ছে। এই অভিন্ন রূপ দেওয়াকে সঠিক বলে আমরা কি লেনিনবাদের জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। না, তা পারি না।

বিষয়— ট্রান্সমিশন বেল্ট, লিভার ও নির্দেশক শক্তির সম্পর্ক। কারখানায় প্রতিটি মেশিনের কাছে মাল দেওয়া-নেওয়া করতে যেমন লিভার ও ট্রান্সমিশন বেল্টের দরকার, তেমনি একনায়কত্বের অধিকার ও দায়িত্ব কার মাধ্যমে সর্বস্তরের শ্রমিকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া যাবে, সেটা বোঝাতে লেনিন-স্তালিন এরকম উদাহরণ দিয়েছিলেন। এরকম ‘ট্রান্সমিশন বেল্ট’ ও ‘লিভার’ কি কি? প্রথমতঃ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন; দ্বিতীয়ত, বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা সহ সব রকমের সোভিয়েত; তৃতীয়তঃ শাখা-প্রশাখা সহ সমবায় সমিতি সমূহ; [এই তিনটি হলো সম্পূর্ণ অ-পার্টি গণসংগঠন]; চতুর্থত, ইয়ুথ লিগ— এটা যদিও অ-পার্টি গণসংগঠন মূলত শ্রমিক-কৃষকের যুব অংশের, কিন্তু পার্টির সাথে ছিল নিবিড় সম্পর্কযুক্ত, যাতে করে ভবিষ্যতের কমিউনিস্ট শক্তি এবং বিভিন্ন গণ সংগঠনে নেতৃত্বকারী শক্তি যোগান পাওয়া যায়। আর পঞ্চমত বা সবশেষে হলো প্রলেতারিয়েতের পার্টি। এর কাজ ছিল সমস্ত গণসংগঠনের কাজগুলি সুসংসহত করা এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, প্রলেতারিয়েতের মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালনা করা। লেনিন তার বিখ্যাত রচনা বামপন্থীকমিউনিজমশিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা-য় বললেন, ‘‘এইভাবে মোটামুটি একটা আনুষ্ঠানিক অ-কমিউনিস্ট, নমনীয় ও বিস্তৃততর এবং শক্তিশালী প্রলেতারীয় ব্যবস্থা আমাদের আছে, যার সাহায্যে পার্টি শ্রেণীজনগণের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলে, যার সাহায্যে পার্টির নেতৃত্বে শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রয়োগ হয়।’’ [জোর লেনিনের]।

এইভাবনাগুলিই মূর্তরূপে পরবর্তীকালে ১৯৩৬ সালের তৃতীয় সংবিধানে, স্তালিন সংবিধানে স্থান পেয়েছে।

১ম পরিচ্ছেদ শেষ

‘‘সাময়িকভাবে বিশাল পশ্চাৎ-লম্বন ব্যতিরেকে বিশ্ব ইতিহাসের গতিপথকে সর্বদা সম্মুখবর্তী ও মসৃণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে অ-দ্বন্দ্বীয়, অবৈজ্ঞানিক ও তত্ত্বগতভাবে ভ্রান্ত।’’

লেনিন— জুনিয়াস প্যামপ্লেট

“It is undialectical, unscientific and theoretically wrong to regard the course of world history as smooth and always in a forward direction, without occasional gigantic leaps back.’’

Lenin– The Junius Pamphlet, Vol 22, P.310

Note : “Thus on the whole, we have a formally non-communist, flexible and relatively wide and very powerful proletarian apparatus, by mean of which the Party is closely linked up with the class and the masses, and by means of which, under the leadership of the party, the class dictatroship is exercised.”

Lenin– Left Wing Communism : An Infantile Disorder.
Coll. Works, Vol-31, p.48

Note : “To sum up : the trade unions, as the mass organisation of the proletariat, linking the Party with the class primarily in the sphere of production; the Soviets, as the mass organisation of working people, linking the Party with the latter primarily in the sphere of state administration; the co-operatives as the mass organisation mainly of the peasantry, linking the Party with the peasant masses primarily in economic sphere, in the sphere of drawing the the peasantry into the work of socialist construction; the Youth League, as the mass organisation of young workers and peasants, whose mission it is to help the vanguard of the proletariat in the socialist education of the new generation and in training young   reserves; and finally the Party, as the main directing force in the system of the dictatorship of the Proletariat, whose mission it is to lead all these mass organisation– such, in general, is the picture of ‘‘mechanism” of the dictatorship, the picture of “the system of the dictatorship of the prolatariat.”

Stalin : Concerning Question of Leninism;

_______________________________________________________________

*কমঃ অসিত ভট্টাচার্য এ.বি. আচার্য ছদ্মনামটিই লেখার সময় ব্যবহার করতেন। এই খসড়া যখন তিনি আমাদের দফতরে জমা দেন এ.বি.আচার্য এই নামটিই উপরের ফুটনোটে তিনি লিখে দিয়েছেন। আমরা সেটিই এখানে অক্ষুন্ন রাখলাম।— সম্পাদক।

ফুটনোট :

১।   See Lenin : Agrarian Programme of Social Democracy in the First Russian Revolution 1905-1907 (Vol-13). “But what is law? The expression of the will of the classes which have emerged victorious and hold the power of the state.” ‘‘কিন্তু আইন কি? যে শ্রেণীগুলি বিজয়ী হয়ে এসে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে, তাদের ইচ্ছার অভিব্যক্তি [হল আইন]।

        এবং Agrarian Programme of Social Democracy in the Russian Revolution (Vol 15). “What is a Law? The Expression of the will of the ruling classes.” ‘‘আইন কি? না, শাসকশ্রেণীগুলির ইচ্ছার অভিব্যক্তি।’’

  ২।   V. I. Lenin : “The essence of a constitution is that of a fundamental laws of the state in general, and the laws governing election to and the powers of the representative institutions it express the actual relation of forces in the class struggle.” ‘‘সাধারণতঃ একটা রাষ্ট্রের মৌলিক আইনসমূহ এবং শ্রেণী সংগ্রামে যথার্থ শক্তি-সম্পর্কের প্রকাশ হিসাবে প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাগুলির ক্ষমতা ও তাতে নির্বাচন-নিয়ন্ত্রক বিধিসমূহ হলো একটা সংবিধানের মূল সারাংশ।’’

        How the Socialist-Revolutionaries sum up the Revolution and How the Revolution has summed them up– Vol. 15

  ৩।   একটু বিশদভাবে জানবার জন্য ভি. আই. লেনিনের “Fifth All-Russian Congress of Soviets of Workers’ Peasants’ Soldiers’ and Red Army Deputies” প্রবন্ধের 189নং টীকাটি (footnote) পড়া যেতে পারে (Vol. 27)।

  ৪।   এপ্রসঙ্গে ‘রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (RSFSR)-এর সঙ্গে প্রথমে কিভাবে আজারবাইজিনিয়ান, আর্মেনিয়ান, জর্জিয়ান, ইউক্রেনিয়ান ও বায়লোরুশিয়ান রিপাবলিক­গুলি এক মঞ্চে এসে USSR গঠন করলো, তা জানা যাবে ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত দশম অল-রাশিয়ান কংগ্রেস অব সোভিয়েতসে জে. ভি. স্তালিন প্রদত্ত রিপোর্টে এবং স্তালিন নির্বাচিত রচনাবলীর ৫ম খণ্ডের ৪৬ এবং ৪৯ নং পাদটীকায়।

  ৫।   “Our grandchildren will examine the documents and other relics of the epoch of the capitalist system with amazement. It will be difficult for them to picture to themselves how the trade in articles of primary necessity could remain in private hands, how factories could belong to individuals, how some men could exploit others, how it was possible for those who did not work to exist. …”         (V. I. Lenin : Vol-29, p. 330)

  ৬।   এপ্রসঙ্গে ব্রাট্রান্ড রাসেলের ভূমিকা সম্বলিত সিডনি ও বিয়াট্রিস ওয়েব দম্পতির লেখা Soviet Communism : A New Civlisation, জি. ডি. এইচ কোল— Principle of Economic Planning, স্যার ওয়াল্টার সিট্রাইন— Search for Truth in Russia, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজের অধ্যাপক অংশু দত্ত— Constitution of Soviet Russia ইত্যাদি ছাড়াও অনেক লেখা/উদ্ধৃতি/মন্তব্য আমাদের বিচারের মধ্যে আনতে হবে। সব বই হয়তো সবার কাছে নেই; কিন্তু সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ও স্তালিন প্রসঙ্গে যে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে, তাতে এরকম মাল-মসলার ইঙ্গিত পাওয়া কঠিন নয়।

  ৭।   “Thus the complete victory of the socialist system in all spheres of the national economy is now a fact.

         And what does this mean?

         It means that the exploitation of man by man has been abolished, eliminated, while the socialist ownership of the instruments and means of production has been established as the unshakable foundation of our Soviet society. …

         “Such, in the main, are the changes which have taken place in sphere of our economy during the period from 1924 to 1936.

         In conformity with these changes in the economy of the U.S.S.R., the class structure of our society has been changed.

         The landlord class, as you know, had already been eliminated as a result of this victorious conclusion of the Civil War. As for the other exploiting classes, they have shared the fate of the landlord class. The capitalist class in the sphere of industry has ceased to exist. And the merchants and profiteers in the sphere of trade have ceased to exist. Thus all the exploiting classes have now been eliminated.

         There remains the working class.

         There remains the peasant class.

         There remains the intelligentsia.”

             Reports Delivered at the Extraordinary 8th. Congress of Soviets
of the U.S.S.R.
, November 2, 1936 by J. V. Stalin;–

                                      from The Foundation of Soviet Constitution

                  Editor Ranjan Bachaspati, International Books, Calcutta-12.

                                                                               (জোর স্তালিনের)

        পাঠকদের বক্তৃতাটি পুরোপুরি পড়তে অনুরোধ করছি।

  ৮।   “Our answer is that antagonism is one form, but not the only form, of the struggle of opposites.

         In human history, antagonism between classes exists as a particular manifestation of the struggle of opposites. Consider the contradiction between the exploiting and the exploited classes. Such contradictory classes co-exist for a long time in the same society, be it slave society, feudal society or capitalist society, and their struggle with each other; but it is not until the contradiction between the two classes develops to a certain stage that it assumes the form of open antagonism and develops into revolution.” …

         “Lenin said, “Antagonism and contradiction are not at all one and the same. Under socialims the first will disappear, the second will remain. … That is to say, antagonism is one form, but not the only form, of the struggle of the opposites; the formula antagonism cannot be arbitarily applied every where.”

  ৯।   “Contradictions in socialist society are fundamentally different from those in the old societies, such as capitalist society. In capitalist society contradictions find expression in acute antagonism and conflicts, in sharp class struggle; they cannot be resolved by capitalist system itself and can only be resolved by socialist revolution. The case is quite different with contradictions in socialist society; on the contrary they are not antagonistic and can be ceaselessly resolved by the socialist system itself.”

                                                             Mao Tse Tung : Vol-V. pp-

১০।   ‘‘আমাদের পার্টির সপ্তদশ কনফারেন্স ঘোষণা করেছিল যে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কার্যকরী করতে অন্যতম যে মৌলিক রাজনৈতিক কর্তব্য সাধন করতে হবে, তা হলো ‘অর্থনৈতিক জীবন ও জনগণের মন থেকে পুঁজিবাদের অবশেষগুলি দূর করা’। এটা একেবারে সঠিক ভাবনা। কিন্তু আমরা কি এটা বলতে পারি যে অর্থনৈতিক জীবন থেকে পুঁজিবাদের অবশেষগুলিকে আমরা ইতিমধ্যেই দূর করে দিতে পেরেছি? না, আমরা এমন কথা বলতে পারি না। আর জনগণের মন থেকে পুঁজিবাদের অবশেষ দূর করার কথা আরও অনেক খাটো করে বলতে হবে। …

         ‘‘এর থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবে এটা বেরিয়ে আসে যে আমাদের পার্টির ব্যক্তি সদস্যদের মনে পরাজিত লেনিনবাদ বিরোধী গ্রুপগুলির মতাদর্শ পুনর্জাগরণে এই অবশেষগুলি অবশ্যই সুবিধা সৃষ্টি করে দেবে। …

         ‘‘এই কারণেই আমরা বলতে পারি না যে লড়াই শেষ হয়ে গেছে এবং সমাজতান্ত্রিক আক্রমণাত্মক পলিসীর আর প্রয়োজন নেই।’’

         তারপর আবার বলেছেন, ‘‘উদাহরণস্বরূপ, এক শ্রেণীহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সমস্যাটির কথা ধরুন [জোর স্তালিনের]। সপ্তদশ পার্টি কনফারেন্স ঘোষণা করেছিল যে আমরা একটা শ্রেণীহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ তৈরীর দিকে যাচ্ছি। এটা বলার কোন বিষয়ই নয় যে শ্রেণীহীন সমাজ আপনা আপনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে না। এটা সমস্ত শ্রমজীবী জনগণের প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে, প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্রের সব অঙ্গগুলিকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে, শ্রেণী সংগ্রামকে তীব্র করার ভিতর দিয়ে, শ্রেণীসমূহকে বিলোপ করার মধ্য দিয়ে, ধনতান্ত্রিক শ্রেণীগুলির ধ্বংসাবশেষসমূহকে দূর করার মাধ্যমে এবং ঘরে ও বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে— তা অর্জন এবং গড়ে তুলতে হয়।’’

        “The 17th. Conference of our Party declared that one of the fundamental political tasks in connection with fulfilment of the Second Five year Plan is ‘to overcome  survivals of capitalism in economic life and in the minds of people.’ This is an absolutely correct idea. But can we say that we have already overcome all the survivals of capitalism in economic life? No, we cannot say that. Still less we can say that we have overcome the survivals of capitalism in the minds of people. …

         “It stands to reason that these survivals cannot but create a favourable soil for the revival of the ideology of the defeated anti-Leninist groups in the minds of individual members of our Party…’

         “That is why we cannot say that the fight is ended and that there is no longer any need for the policy of socialist offensive.” …

         “Take, for example, the problem of building a classless socialist society [emphasis by J. V. Stalin]. The 17th Party Conference declared that we are heading for the formation of a classless socialist society. It goes without saying that a classless society cannot come of itself, spontaneously, as it were. It has to be achieved and built by the efforts of all the working people, by stregthening the organs of dictatorship of the proletariat, by intensifying the class struggle, by abolishing classes, by eliminating the remmants of the capitalist classes and in battles with enemies internal and external.

  1. V. Stalin : Reports to the 17th. Party Congress; Problem of Leninism–
    P.P. 736-737, FLP, Peking 1976.

১১।   “The dictatorhsip of proletariat … is not only the use of force against the exploiters, not even the use of force. The economic foundation of this revolutionary use of force, the guarantee of its effectiveness and success is the fact that the proletariat represents and creates a higher type of social organisation of labour compared with capitalism. This is the essence. This is the source of the strenght and guarantee of the inevitable complete triump of communism.”

                                 Lenin : A Great Beginning; Vol. 24, pp 335-336.

১২।   The scientific concept of dictatorship means nothing more or less than completely unrestricted power, absolutely unimpeded by laws or regulations and resting directly on the use of force.

                                                                   Lenin– Vol. 31, p. 353.

১৩।   “The dictatorship of the proletariat is not the end of the class sturggle, but its continuation in new forms. The dictatorship of the proletariat is the class struggle of the proletariat which has won victory and has seized political power, against the bourgeoise, which although vanquished has not been annihilated, has not disappeared, has not ceased its resistance and has increased its resistance.”

                                                                   Lenin : Vol 29, p. 380.

১৪।

১৫।

১৬।   “Hence the three main aspects of the dictatorship of the proletariat :

         1) The utilization of the rule of the proletariat for the suppression of the exploiters, for the defence of the country, for the consolidation of the ties with the proletarians of other lands, and for the development and victory of the revolution in all countries.

         2) The utilization of the rule of the proletariat in order to detach the labouring and exploited masses once and for all from the bourgeoisie, to consolidate the alliance of the proletariat with these masses, to draw these masses into the work of socialist construction, and to ensure the state leadership of these masses by the proletariat.

         3) The utilization of the rule of the proletariat for the organisation of socialism, for the abolition of classes, for the transition to a society without classes, to a socialist society.

         The proletarian dictatorship is a combination of all these three aspects. No single one of these aspects can be advanced as the sole characteristic feature of the dictatorship of the prolatariat.”

        J.V. Stalin : Concerning Questions of Leninism, Sel Works, Vol.-8, p.31-32

১৭।   “Which is better, to have just one party or several? As we see it now, it’s perhaps to have several parties. This has been true in the past and may well be so for the future; it means long-term co-existence and mutual supervision.

         ‘‘In our country the various democtratic parties, consisting primarily of the national bourgeoisie and its intellectuals, emerged during the resistance to Japan and the struggle against Chiang Kai-shek, and they continue to exist to this day. In this respect, China is different from the Soviet Union. We have purposely let the democratic parties remain, giving them opportunities to express their views and adopting a policy of both unity and struggle towards them. …

         “Since classes and class struggle still exist in China, there is bound to be opposition in one form or another. Although all the democratic parties and democrats without party affiliation have professed their acceptance of the leadership of the Chinese Communist Party, many of them are actually in opposition in varying degrees. … They didn’t want to have a constitution of the socialist type, for, as they said, the Common Programme was just perfect, and yet when the Draft Constitution came out, their hand all went up in favour. Things often turn into their opposites, and this is also true of the attitudes of these democratic parties on many questions. They are in opposition, and yet not in opposition, often proceedings from being in opposition to not being in opposition. …

         “However streamlining the Party and goverment organs does not mean getting rid of the democratic parties. I suggest you to give attention to our united front work so as to improve our relations with them and make every possible effort to mobilise their enthusiasm for the cause of socialism.

                                             Mao Tsetung : Sel. Vol.-V, P. 296-297.

১৮।   “There can be no doubt that this small-peasant class (by middle peasant we mean one who does not sell his labour power) in Russia, at any rate, constitutes the chief economic class which is the source of the broad diversity of political trends among the petty-bourgeois democrats. Here in Russia these trends are associated mostly with the Menshevik and S.R. parties. The history of socialism in Russia shows a long struggle between the Bolsheviks and those parties, while West-European socialists have always regarded this struggle as one within socialism, that is, as a split in Russian socialist movement. …”

         “This is a very complex question with a wealth of history behind it. I need only dwell on it briefly. This policy of the Mensheviks and S.R.s before our very eyes is conclusive proof of our assertion that it is wrong to regard them as socialists. If they had at any time been socialists, it is only in their phraseology and reminiscences; in fact they are nothing but Russian petty bourgeois.” …

         “The Bolshevik Party stood firm then and rightly so. We said we should have to destroy the enemies of the proletariat, and were facing a battle on this fundamental issues of war or peace, of bourgeois representation, and of Soviet government. In all these questions we only had our own forces to rely on, and we were absolutely right when we refused to compromise with the petty-bourgeois democrats.”

  1. I. Lenin : Moscow Party Workers’ Meeting, November 27, 1918,

                                                        Coll. Vol.-28, pp203, 204, 205.

১৯।   In the Soviet Republic it is the class that took power three and half years ago, that has, since then, been exercising its domination– dictatorship– and has suffered and endured exhaustion, want and privation more than any other class. … The class that took political power did so in the knowledge that it was doing so alone. That is intrinsic to the concept of the dictatorship of the proletariat. It has meaning only when one class knows that it is taking political power alone and does not deceive other or itself with talk about “popular government by popular consent through universal suffrage.”

                                                   Lenin : Coll. Vol.-32, pp. 273-274.

২০।   ‘‘এক পার্টি ব্যবস্থা : সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের অবশ্য একটি বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর তা হচ্ছে এক পার্টি ব্যবস্থা। কিছু কিছু রাজনৈতিক গণতন্ত্রী এই কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশ বলতে নারাজ। এ বিষয়টিতে আমাদেরও (আমার ও আমার স্ত্রীর) বেশ খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু ঘটনাসমূহের গভীর তদন্ত ও অধ্যয়নে দেখা যায় যে যখন কোনো একটি বিপ্লবী গভর্নমেন্ট বিভিন্ন জাতি-ধর্ম অধ্যুষিত, এমনকি আদিম গোষ্ঠী অধ্যুষিত নিপীড়িত ও নিরক্ষর জনগণকে শিক্ষিত করে তুলবার সম্মুখীন হয়— যখন তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যই নয়— তাদের নিজস্ব গভর্নমেন্ট পরিচালনার কলাকৌশলেও পারদর্শী করে তুলবার সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন তাদের কাছে বিরোধী পার্টির সুযোগ না দিয়ে এক পার্টি ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। কৃত্রিমভাবে তৈরী করা কোনো বিরোধী তখন কোনো সমধানই নয়। সম্ভবত এই জন্যই সোভিয়েত ইউনিয়নে কৃত্রিম বিরোধী পক্ষ গঠন না করে ট্রেড ইউনিয়ন, সমবায় সমিতি, যৌথ খামার এবং অন্যান্য সমস্ত প্রকারের গণসংগঠন থেকে ‘অ‑পার্টিদের’ প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচনে দাঁড় করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সোভিয়েত নাগরিকদের বিশেষ স্বার্থগুলি তাদের স্ব স্ব গণসংগঠনগুলি তুলে ধরে এবং এইসব গণসংগঠনগুলিরই অধিকার রয়েছে (ধারা নং ৪১) তাদের মনোননীত সদস্যদের ‘অ-পার্টি’ প্রার্থী করার। সুতরাং এক পার্টি ব্যবস্থা থাকলেও, বিরোধী পক্ষ না থাকলেও সমাজের সকল বিশেষ স্বার্থগুলি প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না।

         তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নে এক পার্টি ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা খণ্ডনের জন্যও ব্যবস্থাদি রয়েছে। জনগণের দ্বারা জনগণের গভর্নমেন্টের সবচাইতে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের সমাবেশে মতামত গ্রহণ। আর তা যদি সম্ভব না হয়— সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকার জন্য— তবে গণভোটে জনমত সংগ্রহ (referendum), গণ উদ্যোগ এবং রি-কল (ভোটদাতাদের ভোটের জোরে পদাধিকারীর পদচ্যুতি ও পুনর্নির্বাচন)। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এই ধরনের রাজনৈতিক গণতন্ত্র ছিল প্রচলিত। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে এই গণভোট, গণউদ্যোগ এবং রি-কল পরিত্যক্ত হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই রেফারেন্ডাম বা গণভোট আহ্বান করে।

         সুতরাং এক পার্টি ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা যদিও বা থাকেও— সেই সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের বিকল্প ব্যবস্থাও সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্রহণ করেছে।

        সিডনি ও বিয়াত্রিচ ওয়েব : সোভিয়েত কমিউনিজম : এ ন্যু সিভিলাইজেসন’— মণি গুহ কর্তৃক অনুদিত ও রৌরব পত্রিকার স্তালিন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নতুন সভ্যতা’ নামে প্রবন্ধ থেকে নেওয়া।

২১।   “True enough, in the era of capitalism, when the masses of the workers are subjected to constant exploitation and cannot develop their human capacities, the most characteristic feature of working class political parties is that they can involve only a minority of their class. A political party can comprise only a minority of a class, in the same way as the really class-conscious workers in any capitalist society constitutes only a minority of all workers. … What is this organised minority? If this minority is really class-conscious, if it is able to lead the masses, if it is able to reply to every question that appears on the order of the day, then it is party in reality.

                       [Lenin : (2) Speech on the Role of hte Communist Party;
The Second Congress of the Communist Internationsal,
Col. Works, Vol.-31, p. 235.]

২২।   “Sorin, for example, says that ‘the dictatorship of the proletariat is the dictatorship of our party.’ This thesis, as you see, identifies the ‘dictatorship of the party’ with the dictatorship of the proletariat. Can we regard this identification as correct and yet remain on the ground of Leninism? No, we cannot.”

        [J.V. Stalin : Concerning Questions of Leninism; Sel. Works Vol.-8. p.40].

*   যদিও এখানেও অভিযোগ মতন কোথাও ‘শ্রেণীহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজে’র কথা স্তালিন সরাসরি বলেছেন, তা দেখতে পারছি না— লেখক।

 

Col. Works, Vol. 8, p. 37, 38

Leave a comment