গোর্খাল্যান্ডের দাবি এবং জাতি প্রশ্ন

gorkhaland-20170614093853-1170x645

মৈনাক ভৌমিক

দার্জিলিং পাহাড় আবার অশান্ত হতে শুরু করেছে। গত ২০১১-র ১৮ জুলাই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে পালাবদলের পর ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সইয়ের মধ্যে দিয়ে গঠিত হয়েছিল নতুন স্বশাসিত পর্ষদ— ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (GTA)’। রাজ্য সরকারের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরমের উপস্থিতিতে তাদের প্রতিনিধিরা মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং সই করেছিলেন পাহাড়ের আন্দোলনের পক্ষে প্রতিনিধিত্বকারী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতৃত্বের সাথে। পাহাড়ের অন্যান্য দলগুলো এই সমঝোতাকে জনগণের গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিযোগ করেছিল, তাদের দিক থেকে আন্দোলনকে চালিয়ে যাওয়ার নানা কর্মসূচীও চলেছে বটে, কিন্তু জনভিত্তির বিচারে তাদের সমর্থন খুবই কম। এই সমঝোতাকে ’৮৮-তে সুবাস ঘিসিংয়ের সাথে করা চুক্তির নামান্তর বলে অনেকে বললেও দুটো প্রশ্নে এই চুক্তি অন্ততঃ আগেরটা থেকে আলাদা। প্রথমত, এই চুক্তিতে স্বশাসনের মাত্রা স্পষ্টতই অনেক বেশি এবং দুই, বর্তমান নেতৃত্ব ঘিসিংয়ের মতো করে ভবিষ্যতে গোর্খাল্যান্ডের দাবি আর করবে না বলে কোন মুচলেকা তখন দেয়নি। এর বাইরে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল, চুক্তি সইয়ের গোটা পর্যায় জুড়ে এবং চুক্তির ছত্রে ছত্রে উচ্চারিত হয়েছে ‘উন্নয়নের’ ইস্যু— যার নির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো অবশ্যই নজর করা দরকার। নতুন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-আইটিআই-সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল-ট্যুরিজমের বিকাশের প্রতিশ্রুতি যেমন তাতে আছে, তেমনই আছে এসইজেড গঠনের পরিকল্পনাও, রাজ্যের অন্য জায়গায় যদিও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন এসইজেড স্থাপন নৈব নৈব চ বলে ঢাক পিটিয়েছে এই রাজ্য সরকার। ফলে সাময়িকভাবে বাড়তি ‘স্বশাসন’ ও ‘উন্নয়নে’র আশ্বাসের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছিল গোর্খা জাতিসত্তার আন্দোলন, যা মাঝেমাঝেই আবার নাটকীয় মোড় নিতে থাকে। ইতিমধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সাথে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সম্পর্কের চিড় ক্রমশঃ ফাটলের রূপ নিয়েছে কখনো, কখনো সেসব মেরামতের চেষ্টা চলেছে দুদিক থেকেই। সরকারও আন্দোলনকে দমন করার জন্য নানাবিধ বৈধ-অবৈধ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে নানাসময়। সম্প্রতি লেপচা সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা উন্নয়ন পর্ষদ তৈরীর সরকারী ঘোষণা, গোর্খাল্যান্ডের দাবির বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর কড়া মন্তব্য এবং তত্পরবর্তীতে নানা পদক্ষেপ এবং পাহাড় ও তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে রাজনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তন ও নানাবিধ পক্ষ বদল ক্রমশঃ পরিস্থিতিকে ঘোরালো করে তুলছে। আশাহত হয়েছে জনগণ, না হয়েছে তাদের জীবনের কোনো উন্নতি, না মিলেছে পরিচিতি সত্ত্বার স্বীকৃতি। শাসক, বিরোধী, জোটের রাজনীতি, পঞ্চায়েত ভোট— এসবের আবর্তে চর্চার তলানিতে চলে গেছে ‘নিপীড়িত জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’-এর প্রশ্নটা।

অথচ এই প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসতেই থাকে। কখনো আসাম, নাগাল্যান্ড বা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জনজাতির লড়াই, কখনো খালিস্তান আন্দোলন, কখনো কাশ্মীরের আজাদির স্লোগান, কখনো তামিল ইলমের স্বপ্ন, কখনো বা তেলেঙ্গানার জন্য আত্মাহুতি— এরকম বহু জাতিসত্তার মুক্তির লড়াই, তার জন্য আত্মত্যাগ-শহীদত্ব বরণ— ছবিগুলো একের পর এক ভেসে আসতে থাকে। আর সেই লড়াইগুলোতে দমন করার জন্য রাষ্ট্রের তরফে সন্ত্রাস, অন্তর্ঘাত, আন্দোলনের একাংশকে ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’র মাধ্যমে কব্জায় আনার পরম্পরাও অনবরত চলছে। শুধু ভারতে কেন, সারা বিশ্বে এই জাতি প্রশ্ন তত্ত্বের ধূসরতায় ম্লান হয়ে নেই, জীবনের সবুজে সেই প্রশ্ন প্রতিনিয়তই হাজির হতে থাকে।

জাতি প্রশ্নটা কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে ও তত্ত্বে চিরকালই চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে, তার আলোয় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন ও তার আজকের পরিণতি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করতে গেলে আমাদের বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যেতে হবে। ‘জাতি প্রশ্নে’ বিশদ আলোচনায় বা তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে খুব বেশি না ঢুকে বরং নির্দিষ্টভাবে এই আন্দোলনের প্রসঙ্গেই প্রধানত আমাদের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখা যাক। আর এ প্রসঙ্গে আরও একটা সমস্যা হল, পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে কম্যুনিস্ট আন্দোলনে যখনই এই নিপীড়িত জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেখানে কম্যুনিস্ট শক্তিগুলোর কার্যকরী উপস্থিতি ছিল, বা সমসাময়িক রাজনীতিতে কম্যুনিস্ট শক্তিগুলো প্রাসঙ্গিক ছিল, ফলে শ্রেণি রাজনীতির নিরিখে কিভাবে এই লড়াইগুলোকে দেখা উচিত বা গড়ে তোলা উচিত, সে বিষয়ে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগণ্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে হাজির করা তত্ত্বগুলো অনেক প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনের মধ্যে কম্যুনিস্ট রাজনীতির উপস্থিতি বা সংসদীয় বামদের এই দাবির প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের জেরে এখানে সেই পরিপ্রেক্ষিতটা একেবারেই আলাদা। দার্জিলিংয়ের গোর্খা জাতিসত্তার এই দাবিকে বুঝতে বা যাচাই করতে গেলে আমাদের অবশ্যই শুরু করতে হবে এখানকার ইতিহাস থেকে।

ইতিহাসের শুরু

দার্জিলিংয়ের ইতিহাস নিয়ে বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সাড়ে তিন শতাব্দী আগে। নেপালের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারবার শুরু হয় ১৭৬৭ তে। কাঠমান্ডু উপত্যকাতে চারটি ছোট ছোট নেওয়ারি বা মাল্লা রাজার সাম্রাজ্য ছিল তখন। মাল্লা রাজাদের রাজত্বের অন্তিমকালে ভেঙ্গে যাওয়া এবং দুর্বল হয়ে পড়া ঐক্যবদ্ধ নেপাল সাম্রাজ্যকে পুনর্গঠনের কথা বলে গোর্খা রাজা পৃথ্বীনারায়ণ শাহ সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করেন, গিলে নেন ওই চারটি ছোট রাজ্যকে। এই চার রাজা ১৭৬৭ তে ব্রিটিশের কাছে সাহায্য চাইলে ব্রিটিশরা সাহায্য পাঠায়, এবং প্রাথমিকভাবে পৃথ্বীনারায়ণ শাহকে রুখে দিলেও দুবছর বাদে ব্রিটিশ সাহায্য প্রত্যাহৃত হয়, এবং পৃথ্বীনারায়ণ শাহ তার রাজধানী স্থাপন করেন কাঠমান্ডুতে। শুরু হয় তার বিজয়যাত্রা। পশ্চিমে পাঞ্জাব থেকে পূর্বে সিকিম পর্যন্ত বিস্তৃত হয় সেই সাম্রাজ্য। বিভিন্ন সময়ে এই সব রাজ্য জয় করতে গিয়ে ব্রিটিশের থেকে অস্ত্র বা পরামর্শ যেমন তিনি নিয়েছিলেন, তেমনি শান্তিপূর্ণভাবে এক দূরত্বের সম্পর্কও বজায় রেখেছিলেন, সুরক্ষিত রেখেছিলেন তার সাম্রাজ্যের সীমানাকে।

১৭৭৩ সালে তিনি জয় করেন বিজয়পুর রাজ্য, যা বিস্তৃত ছিল পূর্বে তিস্তা নদী পর্যন্ত। আজকের দার্জিলিং, কার্শিয়াংয়ের মত এলাকাগুলো, যা তিস্তার পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত, সেগুলোও এই বিজয়পুর রাজ্যের মধ্যেই ছিল। ১৭৮৮ তে বিভিন্ন এলাকার সাথে এই পাহাড়ের অঞ্চলও পৃথ্বীনারায়ন শাহের সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।

তিস্তার পূর্ব পাড়ে অবস্থিত কালিম্পং অবশ্য প্রথমে সিকিমের রাজা এবং পরে ভুটান রাজার অধীনে ছিল। ১৭০৬ তেই সিকিমের রাজাকে হারিয়ে ভুটানের রাজা কালিম্পং দখল করেছিল। তিস্তার পশ্চিমপাড়ে প্রধানত লেপচা, মুর্মি ও লিম্বু উপজাতির মানুষ বাস করতেন, ছিলেন নেপালিরাও, তাদের বিভিন্ন উপজাতি— যাদের সংখ্যা প্রথমে কম ছিল, পরে ক্রমশ বাড়তে থাকে গোর্খা সাম্রাজ্যের এই বিস্তারের পর। অন্যদিকে তিস্তার পূর্ব পাড়ে আদি বাসিন্দা লেপচাদের পাশাপাশি বাইরে থেকে এসেছিলেন ভুটিয়া ও লিম্বুরা। ১৭৮০-র পর আসতে শুরু করে গোর্খারাও। ফলে একটু আগে-পরে হলেও এই অঞ্চলে এরকম বিভিন্ন জাতির মানুষদের বসবাসের ইতিহাসটা অনেক পুরনো।

উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাহাড় সম্পর্কে খুব আগ্রহী হয়ে পড়ে, এবং ১৮৩৫ থেকে ১৮৬৫— এই তিরিশ বছরের মধ্যে নানা ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে তা হস্তগত করে তারা। ১৮১৪তে যুদ্ধ বাঁধে ব্রিটিশ ও নেপালের মধ্যে, যাতে ব্রিটিশরা সিকিমের মানুষদের সাহায্য নিয়ে নেপালের গোর্খা সাম্রাজ্যকে হারিয়ে দেয়। ১৭৮৮-৮৯তে নেপালের দখলে আসা তিনটি মহকুমাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুগৌলির চুক্তি (১৮১৫) মারফত দখল করে, এবং তারই সাথে তিব্বতে বিস্তার লাভের লক্ষ্যে সিকিমের সাহায্য প্রয়োজন হতে পারে এই দুরভিসন্ধি নিয়ে, সিকিমের চোগিয়ালের (রাজা) কাছে উপহারস্বরূপ মেচি ও তিস্তার মধ্যবর্তী এই অঞ্চল তিতালিয়া চুক্তির (১৮১৭) মারফত ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তাতে শর্ত রাখা হয় যে, নেপাল ও সিকিমের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যেকোনো বিবাদে সিকিমের রাজাকে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ চাইতে হবে, এবং ব্রিটিশদের সিদ্ধান্তকে সেই প্রশ্নে মেনে নিতে হবে।

অন্তুডাঁরা বলে একটা জায়গা নিয়ে এরকম একটা বিবাদের সময়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুই অফিসার জর্জ অ্যালিমার লয়েড ও জে ডব্লিউ গ্রান্ট ১৮২৯-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘দোর্জিলিং’ নামের এক পাহাড়ি অঞ্চলে কিছুদিন থাকেন এবং সেখানে সম্ভাব্য স্বাস্থ্যনিবাস তৈরির প্রস্তাব দেন। সেই অনুযায়ী ব্রিটিশরা এগোয় এবং ১৮৩৫ সালে তাদের তৈরি করা চুক্তিপত্রের ওপর সিকিমের রাজার সিলমোহর আদায় করে নেয়। এই আদায় করা অঞ্চল দার্জিলিং ট্র্যাক্ট নামে পরিচিত হয়, যার জন্য বছরে ৩০০০ টাকা দেওয়ার শর্ত হয়, পরে যা বেড়ে ৬০০০ টাকা হয়। প্রথমে যে চুক্তিপত্রটা দেখানো হয়েছিল, তাতে শুধু দার্জিলিং শহরের কিছুটা অংশ বলে উল্লেখ থাকলেও, পরে যে চুক্তিপত্রটাতে ব্রিটিশরা রাজার সিলমোহর আদায় করে তাতে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩০ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৬-১০ মাইল এলাকার কথা বলা হয়। চুক্তিপত্রটি লয়েড পেশ করেছিলেন লেপচা ভাষায়, যা সিকিমের রাজা বুঝতেন না। সিকিমের রাজার বোঝাপড়ায় ছিল যে এই চুক্তি মোতাবেক তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন, কিন্তু তাও তিনি পাননি। পরে ব্রিটিশরা ওই অঞ্চলে রাস্তাঘাট-বাড়িঘর তৈরি করতে শুরু করলে সিকিমের রাজা আরও জোরালো প্রতিবাদ করতে শুরু করেন এবং ব্রিটিশরা বোঝে যে এখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, তাই তারা ক্ষতিপূরণ বাবদ একটা দো-নলা বন্দুক, একটা রাইফেল, কুড়ি গজ লাল কাপড় এবং দুটো শাল সিকিমের রাজাকে পাঠিয়ে দেন!

নানা কারণে এই চুক্তিটি অবাস্তব হলেও, তার শর্তগুলো পূরণ করা অসম্ভব হলেও, ব্রিটিশদের পক্ষে এই অঞ্চল ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ অনেক টাকা তারা ইতিমধ্যেই খরচ করে ফেলেছে, অনেক জমি বিক্রি করে দিয়েছে কলকাতার প্রভাবশালী লোকদের এবং সর্বোপরি পূর্ব ভারতে এরকম একটা স্বাস্থ্য নিবাস— যাকে তারা বলে ‘হোম ওয়েদার’, সেটা যেকোনো মূল্যে তাদের দরকার ছিল। চুক্তিটা এমনভাবে হয়েছিল যাতে দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তাটা তখনো ব্রিটিশের হাতে আসেনি। ১৮৪৯ সালে সিকিম রাজ্যের গহীন অঞ্চলে ঢুকে যাওয়ার জন্য দুই ব্রিটিশকে সিকিম রাজা বন্দী করে। এই অজুহাতে ব্রিটিশ সেনা সিকিমে ঢোকে, এবং সেখানে কিছুদিন থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জানিয়ে দেয় যে, এই অঞ্চল এখন থেকে ব্রিটিশদের দখলে থাকবে। ১৮৫০-এ এভাবেই শিলিগুড়ি দার্জিলিংয়ের অংশ হয়ে যায়। আজকের কালিম্পং মহকুমা ও ডুয়ার্স সহ সমগ্র অঞ্চল ব্রিটিশদের হাতে আসে ১৮৬৫-র নভেম্বরে ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।

এই অঞ্চলকে প্রথমে পশ্চিম ডুয়ার্সের মধ্যে রাখা হলেও ১৮৬৬ তে দার্জিলিংয়ের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়, জেলা হিসেবে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় দার্জিলিং। প্রথমে এই নবগঠিত জেলাকে ‘নন-রেগুলেশন ডিস্ট্রিক্ট’ বলে চিহ্নিত হয়, অর্থাৎ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কোন আইন-বিধি এখানে (বিশেষ উল্লেখ না থাকলে) প্রযোজ্য নয়। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ হলে দার্জিলিংকে ঠেলে দেওয়া হল বিহারের ভাগলপুর সাব-ডিভিশনে। ১৯১৯ সালে আবার বদলে দিয়ে এরকম করা হল যে, বাংলার সরকারের তৈরি করা কোন আইন, রাজ্যপাল খারিজ করে দিলে, তা আর এই জেলায় প্রযোজ্য হবে না। এভাবে চলল ১৫ বছর, এবং তারপর দার্জিলিংয়ে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের শততম বছরে তা জুড়ে নেওয়া হল বাংলার ভিতরে, এখান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি গেল বাংলার বিধানসভায়। প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হলেন ডম্বরসিং গুরুং।

‘হোম ওয়েদারের’ লোভ ছাড়াও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দার্জিলিংয়ের ব্যাপারে আগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ ছিল। স্থলপথে তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের প্রয়োজনে চীন ও তিব্বতের থেকে ভারতের উত্তর সীমান্তকে সুরক্ষিত করাটাই ছিল তাদের সিকিম, ভুটান ও নেপাল সম্পর্কিত বৈদেশিক নীতির নির্যাস। সিকিম ছিল বিশেষ গুরুত্বের, তার সীমান্ত ছুঁয়ে আছে চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারতকে। এই ছোট্ট রাজ্যের মধ্যে দিয়েই ছিল ভারত ও তিব্বতের মধ্যের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কালিম্পং-লাসা বাণিজ্যিক পথ। পৃথ্বীনারায়ন শাহ-র নেপাল বিজয়ের পরে এমনিই সেই পথ সুগম হয়েছিল।

সুগৌলি চুক্তির পরে নেপালের গোর্খা রাজারা সাধারণভাবে ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে এসেছে। দার্জিলিং ব্রিটিশদের হাতে আসার পর দার্জিলিংয়ের মধ্যে দিয়ে সিকিম, নেপাল ও তিব্বতের সাথে ঘোড়া, কম্বল, চা, আলকাতরা, কয়লা, উল, বাদ্যযন্ত্র, জুতো প্রভৃতি আমদানি এবং চাল, নুন, নীল, তামা ও দস্তা, তামাক রপ্তানির ব্যবসা চলতে থাকে।

গোর্খা রাজাদের শক্তিহীন করে দিয়ে রাণা রাজবংশের জঙবাহাদুর রাণা নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলে নিজেকে ঘোষণা করে বসলে ব্রিটিশের প্রতি তাদের আনুগত্য আরও প্রতিষ্ঠিত হল। জঙবাহাদুর রাণা শুধু ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে ব্রিটিশদের সামরিক সাহায্যই দিল না, সিপাহী বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে তিনি ব্রিটিশের পক্ষে নেপালি সেনাদের নেতৃত্ব দেন, এবং বিদ্রোহীদের হাত থেকে লক্ষ্ণৌ উদ্ধার করেন। এই ভূমিকার ফলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য ব্রিটিশরা দার্জিলিংকে একটা স্থায়ী কেন্দ্র হিসেবে দেখতে শুরু করে, কারণ কাঠমান্ডুর রাজারা নেপালের মাটিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগের পক্ষে ছিলেন না। সমস্ত নেপালিভাষীরাই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ‘গোর্খা’ হিসেবে নামাঙ্কিত হয় এবং আনুগত্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সংস্পর্শে না থাকায় তাদের নিয়োগের ব্যাপারে ব্রিটিশরা খুবই উত্সাহিত ছিল, এবং তাদের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।

নেপালি রাজারা ধর্মের দিক থেকে প্রধানতঃ হিন্দু। ফলে তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তিব্বতি ও ভুটিয়াদের সাবেকি শত্রু হবে বলে ব্রিটিশরা মনে করেছিল। ব্রিটিশরা বুঝেছিল যে এরা দলাই লামাদের বিরোধিতা করবে, ফলে ভুটান ও সিকিমে একটা নেপালি জমিদার শ্রেণি তৈরির চেষ্টা করে গেছে ব্রিটিশরা।

জনজাতির বিন্যাস

১৮৬০-এর দশক থেকে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ আবহাওয়ায় কোন রকম বিরোধ ছাড়া গড়ে উঠতে থাকে শহর, শহরের নানা পরিকাঠামো। ইতিমধ্যে চা-বাগান গড়ে উঠেছে দার্জিলিংয়ের চারদিকে, মূলতঃ তিস্তার পশ্চিম পাড়ে। ১৮৩৫ সালে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা ছিল বড়জোর ১০০। কিন্তু এই চা বাগানগুলোতে কাজ, শহর-রাস্তাঘাট গড়ে তোলা, কৃষির প্রসার, সেনাবাহিনীতে কাজের জন্য ব্রিটিশদের প্রয়োজন ছিল অনেক অনেক শ্রমজীবী গরিব মানুষ। ১৮৭২ সালে দার্জিলিংয়ে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ৭৪, যা ১৯০১ সালের মধ্যে বেড়ে হল ১৭০। দলে দলে মানুষ আসতে থাকে, ১৮৭১-৭২ এ জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪৭১২, ১৮৮১ তে ১৫৫১৭৯, ১৯০১-এ ২৪৯১১৭। ১৮৯৮ সালে তৎকালীন সেটেলমেন্ট অফিসার শশিভূষণ দত্ত-র দেওয়া রিপোর্ট অনুসারে দার্জিলিং ও তরাইয়ে বিভিন্ন জনজাতির বিন্যাসটা দেখা যাক। কোচ-১১১৩৩, নেপালি-১০৩৫৪, শেক-৬৩০১, ওরাওঁ-৪৬৩২, লেপচা-১১২২, ভুইমালি ও মেহেতার-১০৭৯, বুরা-৬৪৪, রাজপুত-৫০৯, ভুটিয়া-৪২০, মুন্ডা-২৫৫।

এখন এই তথ্যকে ঘিরে নানারকম মতামত-সংশয় আছে। অনেকের মতে, এই নেপালি মানুষদের বেশিরভাগটা নেপাল থেকে এসে এখানে থাকতে শুরু করেছে। অনেকের মতে, তারা এখানকারই বাসিন্দা। চা বাগানের কাজে যারা যুক্ত ছিল তাঁদের দুটো অংশ— যারা স্থায়ী বাসিন্দা তারা সারা বছর কাজ করতেন, আর একদল শীতের সময়ে আসতেন পশ্চিমের নেপাল থেকে যারা কিছুদিনের জন্য চুক্তিভিত্তিক কাজ করে আবার চলে যেতেন। এই মতের ঐতিহাসিকরা বলছেন, ব্রিটিশরা নেপাল থেকে বন্দী শ্রমিকদের নিয়ে আসেনি, নেপালি শ্রমিকরা এখানে আদি বাসিন্দা হিসেবেই ছিল, বন্দী করে আনা হয়েছিল ছোটনাগপুর থেকে আদিবাসী শ্রমিকদের, যারা এখানে কাজ করতে এসে আবহাওয়ার সাথে এঁটে উঠতে না পেরে তরাইয়ের জঙ্গলের দিকে নেমে চলে যায়, পরে তরাই-ডুয়ার্সে চা বাগান গড়ে উঠলে তারা সেখানে কাজ করতে শুরু করে।

যাই হোক, এটা স্পষ্ট যে এই বিশাল নেপালি জনসংখ্যাটা বহুদিন ধরেই এখানে আছে, যদি ধরে নেওয়া যায় তারা বাইরে থেকে এসেছেন, তাহলেও সেটা বহুযুগ আগের কথা। ওই সেটেলমেন্ট অফিসারের তথ্য থেকে আর একটা জিনিসও স্পষ্ট যে বাঙালিরা এখানে ছিলই না। নেপালি বসতি বেড়ে চলার সাথে সাথে খুব কম সংখ্যায় হলেও বাঙালি মধ্যবিত্তরাও সমতল থেকে পাহাড়ে প্রশাসনিক কাজে ও চা বাগানের ম্যানেজার ও কেরানি পদে আসতে থাকে, এবং মূলতঃ পাহাড়ের শহরাঞ্চলগুলোতে বসবাস শুরু করে। আর আসে বিহারী ও মারোয়ারী ব্যবসাদাররা, তাদের হাতে যেতে থাকে খুচরো ও পাইকারি ব্যবসা। ১৯৪১ সাল নাগাদ জনসংখ্যার হিসেবে পাহাড়ের তিনটি মহকুমায় বাঙালি, বিহারী, মারোয়ারী মিলিয়ে ছিল ৫.১%, এবং ৮৬.৮% মানুষ নেপালি-ভাষী। অন্যদিকে, শিলিগুড়ি মহকুমায়, যার বেশিরভাগটাই সমতল, এবং লাগোয়া তরাইয়ের জঙ্গল ও চা বাগান, সেখানে বাঙালি সংখ্যাধিক, যা আরও বেড়ে গেল ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে।

যে নেপালি ভাষা প্রচলিত হতে থাকলো, সেটা সপ্তদশ শতকের শেষে নেপালে ‘খাসকুরা’ বা ‘গোর্খা’ ভাষা বলে পরিচিত ছিল। যদিও নেপালে এই ‘খাসকুরা’ ভাষা মূলতঃ উচ্চবর্ণীয় বাহুণ-ছেত্রী (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়) দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি পৃথ্বীনারায়ন শাহের নেতৃত্বে গোর্খা জাগরণের পরও এই ভাষা নিম্নবর্ণের তিব্বতি-বর্মী (টিবেটো-বার্মীজ) ভাষাভাষী আদিবাসী-জনজাতির মানুষদের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছিলো না। কিন্তু দার্জিলিংয়ে ব্যাপারটা অন্যরকম হলো। এখানে চলে আসা তিব্বতি-বর্মী ভাষাভাষী রাই, লিম্বু, প্রধান, গুরুং, তামাং, কিরাতরা তাদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উচ্চবর্ণীয়দের ‘খাসকুরা’কে গ্রহণ করতে লাগলো। এটাই পাহাড়ের জন্য লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা অর্থাৎ যোগাযোগের মূল ভাষা হয়ে ওঠে। অন্যান্য ভাষা, বিভিন্ন উপজাতির ডায়ালেক্টগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। এমনকি লেপচা ও ভুটিয়ারাও ধীরে ধীরে এই ভাষাকে গ্রহণ করার দিকেই এগিয়েছে।

আর একটা দিক ছিল নিম্নবর্ণের নেপালি অভিবাসীদের ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতকরণ। হিন্দু ধর্মস্থান বাড়তে লাগলো এবং অচিরেই বৌদ্ধ ধর্মস্থানের তুলনায় তা অনেক বেড়ে গেল। অন্যদিকে, বাড়তে লাগলো অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশের সংখ্যা, যারা ব্রিটিশের ‘অনুগত’ হিসেবে পরিচিত। এভাবেই একটা মিশ্র নেপালি সংস্কৃতির সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করে, যা অর্থনীতির হিসেবে আড়াআড়িভাবে ভাগ হয়ে আছে। একদিকে জমিদারশ্রেণি, অবসরপ্রাপ্ত সেনা-পুলিশ আর অন্যদিকে মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবী, ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চা বাগানের শ্রমিক, নির্মাণ কর্মী, ছোট চাষি ও খেতমজুররা।

শতবর্ষের দাবি

একদিকে জনজাতির বিন্যাসে পাহাড়ের ওই অঞ্চলে সংখ্যাগতভাবে নেপালিদের প্রাধান্য আর অন্যদিকে দার্জিলিংকে জেলা হিসেবে ঠিক কী স্ট্যাটাস দেওয়া হবে, তা কোথায় যাবে সে ব্যাপারে ব্রিটিশদের খামখেয়ালিপনার প্রতিক্রিয়ায় ১৯০৭ সালে পাহাড়ের একটা অভিজাত অংশ— তাদের মধ্যে আছে অবসরপ্রাপ্ত নেপালি পুলিশ ও সেনারা, আছে ধনী ব্যবসায়ীরা, আছে অবস্থাপন্ন তিব্বতি ও ভুটিয়ারাও— ‘হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে প্রথম মেমোরান্ডাম জমা দিলো সরকারের কাছে। তারা দাবি করল বাংলার বাইরে ‘একটা পৃথক প্রশাসনিক ব্যবস্থা’। যদিও এই ১৯০৭ থেকে শুরু করে তার পর থেকে কিছু বছর অন্তর অন্তরই এই ‘হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশন’ পৃথক ব্যবস্থার দাবি পেশ করতে থেকেছে সরকারের কাছে। তার বিশদে যাওয়ার দরকার নেই। শুধু এটুকু বলার যে, এই ‘হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশন’ তাদের বক্তব্যে ব্রিটিশের প্রতি তাদের আনুগত্য এবং ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের’ প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছে। তাদের দাবিপত্রগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করছে।

এই দাবিদাওয়ার পথে দ্বিতীয় ঘরানাটা তৈরি হয় দার্জিলিংয়ের একটা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত অংশের হাত ধরে। এই মানুষদের একজোট হওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা নেয় ভাষা। শিক্ষার উদ্দেশ্যে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসা নানা অংশের ভূমিকা ছিল এতে। ১৯০৬ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিলো ‘গোর্খা সাথী’ পত্রিকা, নেপালি ভাষী মানুষদের মধ্যে দেশপ্রেমের ভাবনা সঞ্চারিত করার উদ্দেশে, পরে ব্রিটিশ সরকার তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই অংশের অনেকের সাথে যোগাযোগ ছিল স্বদেশী আন্দোলনের, এমনকি অনেকের সম্পর্ক ছিল বাংলার চরমপন্থীদের সাথেও। পরশমণি প্রধান, সূর্যবিক্রম ঘেওয়ালি, ধরণীধর শর্মা সহ অনেকে গড়ে তোলেন নেপালি সাহিত্য সম্মেলন, নেপালি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের লক্ষ্যে। ভাষার স্বীকৃতির নানা দাবিদাওয়া রাখতে থাকেন তারা। তারা হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশনের দিক থেকে রাখা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবির বিরোধিতা করে বলেন যে এটা গরীব নেপালীদের পশ্চাদপদতাকে বাড়াবে মাত্র, এবং ১৯২০ সালে একটা পৃথক দাবিপত্রে তারা বাংলার মধ্যে পৃথক স্বশাসনের দাবী রাখেন। এই সময় চা বাগানগুলোতে ছড়াতে থাকে গান্ধীবাদী অসহযোগ আন্দোলন, দল বাহাদুর গিরি প্রভৃতি শিক্ষিত নেপালিদের একটা অংশের হাত ধরে। ১৯২৩ সালে দলবাহাদুর গিরির অকালমৃত্যু হলে ১৯২৪ সালের হাতিয় কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী শোকবার্তা পেশ করেন। এভাবে চলতে চলতেই ১৯৪৩ সালে ডম্বরসিং গুরুংয়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হল সারা ভারত গোর্খা লীগ। গোর্খা লীগ এক অর্থে হিলমেনস অ্যাসোশিয়েশনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে। তারা কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে পাহাড়ের মানুষের অসন্তোষ নিয়ে কথা বলা শুরু করলো। একই বছরে গড়ে উঠলো ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দার্জিলিং শাখা, যার সদস্যরা প্রথম দিকে গোর্খা লীগের মধ্যে কাজও করতেন।

পাহাড়ে কমিউনিস্ট পার্টি

১৯৪৩-এ বাংলায় দেখা দিল মন্বন্তর। অন্যদিকে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। একদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি তখন কমিউনিস্ট পার্টি কালোবাজারি-মজুতদারির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জোরদার করার চেষ্টা করছে, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তখন জনগণের রিলিফ কমিটি তৈরির উদ্যোগ চলছে। পাহাড়ে নবগঠিত গোর্খা লীগ বা পুরনো দল জাতীয় কংগ্রেস এই নিয়ে কিছু করেনি। সেই সময় শিলিগুড়ি এলাকার কাজ পরিচালিত হত জলপাইগুড়ি থেকে, পাহাড়ের সাথে তার যোগাযোগ ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির পক্ষ থেকে দার্জিলিংয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় সুশীল চ্যাটার্জীর ওপর। রতনলাল ব্রাহ্মণ নামে একজন ড্রাইভার, যিনি মাইলা বাজে (মেজ ঠাকুরদা) নামে বিশেষ পরিচিত ছিলেন, তার বন্ধুদের নিয়ে গুদাম লুঠ এবং জনগণের মধ্যে তা বিতরণের কাজ করছিলেন বলে সুশীল চ্যাটার্জি শুনতে পান, এবং তার সাথে যোগাযোগ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শের কথা শুনে রতনলাল ব্রাহ্মণ প্রভাবিত হন এবং দ্রুতই তার নেতৃত্বে প্রথমে ড্রাইভার ইউনিয়ন, তারপর তার উদ্যোগে একের পর এক গাড়োয়ান ইউনিয়ন, রিকশাওয়ালা ইউনিয়ন, দিনমজুর ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, মহিলা সমিতি এবং কিষাণ সভা গড়ে ওঠে। রতনলাল ব্রাহ্মণের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল গোর্খা দুঃখ নিবারক সম্মেলন। দার্জিলিংয়ে পার্টির একটা জেলা সংগঠনী কমিটি গঠন করা হয়, যার সদস্য ছিলেন সুশীল চ্যাটার্জি, রতনলাল ব্রাহ্মণ, গনেশলাল সুব্বা, ভদ্র বাহাদুর হামাল ও চারু মজুমদার। গনেশলাল সুব্বা ছিলেন তৎকালীন সেই কমিটির সম্পাদক। ১৯৪৬-এ ব্রিটিশ ভারতের শেষ নির্বাচনে দার্জিলিংয়ে দুটি নির্বাচনী কেন্দ্র হল। সাধারণ কেন্দ্রটিতে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে আগেরবারের মতই ডম্বরসিং গুরুং জিতলেন। অন্যটি ছিল বারোটি চা বাগান সম্বলিত শ্রমিক নির্বাচনী কেন্দ্র। চা বাগান মালিকদের মদতপুষ্ট কংগ্রেসের প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচনে জিতলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ। সারা রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টির জেতা তিনটে সিটের মধ্যে একটা এখান থেকেই। প্রথম জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল দার্জিলিংয়ের জলাপাহাড়ে স্নেহাংশু কান্ত আচার্য্যর বাড়িতে। প্রাদেশিক কমিটির পক্ষে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সরোজ মুখার্জী ও ভবানী সেনগুপ্ত। সেই সম্মেলনে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়—

“স্বাধীন ভারতে স্বাধীন গোর্খাস্থানের দাবী, যা জেলা কমিটির দিক থেকে বারংবার পেশ করা হয়েছে তা আবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হচ্ছে। গোর্খাস্থানের দাবীটা তত্কালীন সিপিআই দার্জিলিং জেলা কমিটি সম্পাদক গনেশলাল সুব্বা এবং দার্জিলিংয়ের সিপিআই বিধায়ক রতনলাল ব্রাহ্মণের সুচিন্তিত মতামত নয়, বরং তত্কালীন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও পার্টির আদর্শগত ও তাত্ত্বিক দিশাকে মাথায় রেখে দার্জিলিংয়ের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে এই দাবিটা করা হয়েছিল।”

এই সিদ্ধান্তটি উচ্চতর নেতৃত্বের উপস্থিতিতে হওয়ায় এটা ধরেই নেওয়া যায় যে, এটাতে পার্টির দ্বিমত ছিল না। সেই মোতাবেক, রতনলাল ব্রাহ্মণ এবং গনেশলাল সুব্বার উদ্যোগে ১৯৪৭-এর ৬ই এপ্রিল নেপালি-ভাষী জনগণের পক্ষ থেকে ভারতের সংবিধানসভার কাছে দাবিপত্র পেশ করা হয়। দাবিপত্রের প্রতিলিপি পাঠানো হয় তদারকি সরকারের প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা জহরলাল নেহেরু ও অর্থমন্ত্রী এবং মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানের কাছেও। বিভিন্ন ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত কারণ দেখিয়ে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও গনেশলাল সুব্বা স্বাক্ষরিত সেই দাবিপত্রে লেখা হল—

“ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মতে, দার্জিলিং জেলা গোর্খাদের এবং এটাই তাদের মাতৃভূমি। তাছাড়া, এটা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সুচিন্তিত মতামত যে, দার্জিলিং জেলায়, সংলগ্ন রাজ্য সিকিমে এবং তথাকথিত স্বাধীন রাজ্য নেপালে যথাক্রমে যে ৩ লক্ষ, ১ লক্ষ এবং ৬০ লক্ষ গোর্খা মানুষ বসবাস করেন, তারা স্পষ্টতই একটা নির্দিষ্ট জাতিসত্ত্বা গঠন করছে, যাদের একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, এবং একই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, অতঃপর, দাবি করছে যে, বর্তমানের সীমানাগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধনী করার পর দার্জিলিং জেলার তিনটি সংলগ্ন অঞ্চল, দক্ষিণ সিকিম, এবং নেপালকে জুড়ে একটা একক অঞ্চল গঠন করা হোক, যার নাম হবে গোর্খাস্থান…

…ভারত সরকার আইন, ১৯৩৫-এ দার্জিলিং জেলাকে যেভাবে একটা ‘আংশিক বহির্ভূত এলাকা’ বলা হয়েছে, সিপিআই অবিলম্বে তার অবসান চায় এবং তারই সাথে জেলায় বসবাসকারী গোর্খা ও অন্যান্য জনজাতির মানুষদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির অগ্রগতির একটা প্রাথমিক ধাপ হিসেবে আমলাতন্ত্রের সমস্ত বিশেষ ক্ষমতারও অবসান চায়।”

কিন্তু গনেশলাল সুব্বা, যিনি ছিলেন সেই সময় কম্যুনিস্ট পার্টির দার্জিলিং সংগঠনী কমিটির সম্পাদক, তিনি পরবর্তীতে বহিষ্কৃত হন। এবং পরবর্তীতে কম্যুনিস্ট পার্টির তরফে এও বলা হয় যে, পূর্বোল্লেখিত প্রস্তাবটিকে পার্টির জেলা, প্রাদেশিক বা জেলা কমিটি অনুমোদন দেয়নি। এই বিষয়টিকে ঘিরে স্বভাবতঃই চাপানউতোর আছে।

এর আগে পর্যন্ত দার্জিলিংয়ের আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য যতবার দাবি পেশ করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশনের নামে। হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশনের হল ব্রিটিশদের দালাল — এই অভিযোগ তুলে কমিউনিস্ট পার্টি এ প্রসঙ্গে একটা ডেপুটেশনে লিখেছিল যে,

“১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতসচিব লর্ড পেথিক লরেন্সকে দেওয়া হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশনের স্মারকলিপি অনুযায়ী দার্জিলিং জেলাকে বাকি ভারতের থেকে এবং তার সংবিধান থেকে বিচ্ছিন্ন করে এটাকে মুখ্য কমিশনারের আওতাভুক্ত একটি প্রদেশে পরিণত করার যে ভয়াবহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত, তাকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তীব্রভাবে বিরোধিতা করছে। এই অ্যাসোসিয়েশন (হিলমেনস অ্যাসোসিয়েশন) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের স্থানীয় প্রতিনিধি ভিন্ন আর কিছুই নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা পেশ করা এরই রকমফের যে কোনো ধরণের প্রস্তাবের বিরোধী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। এটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা দার্জিলিং জেলাকে আসাম ও ডুয়ার্সের অন্যান্য জনজাতির মানুষদের সাথে জুড়ে উত্তর-পূর্ব হিমালয় পার্বত্য প্রদেশ নামে সম্পূর্ণ একটা নতুন জেলায় জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে”।

’৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর, তার পরের মাসেই অনুষ্ঠিত হয় কম্যুনিস্ট পার্টির চতুর্থ প্রাদেশিক সম্মেলন। তারপর ১৯৫১-র কলকাতা কংগ্রেসে স্পষ্টভাবে উঠে এল দেশ বা রাজ্য নয়, জেলাগত স্বায়ত্তশাসনের কথা। সেই সময়ে কম্যুনিস্ট পার্টির যারা গোর্খা জনজাতির মানুষদের মধ্যে কাজ করতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সত্যেন্দ্রনারায়ন মজুমদার, তিনি দার্জিলিংয়ের জাতি সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন বইও লেখেন। গোর্খা লীগের সাথে পার্থক্যরেখাকে স্পষ্ট করতে গিয়ে তিনি যা লেখেন, তাতেও স্বায়ত্তশাসনের বক্তব্যই যে কম্যুনিস্ট পার্টির ছিল, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়—

“গোর্খা লীগের দাবী হল যে দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়িকে আসামের সঙ্গে মেলাতে হবে নতুবা দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা মিলিয়ে গড়তে হবে একটি গোর্খাপ্রদেশ। আর আমাদের আওয়াজ হল দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত জেলা গঠন। শুধু এই আওয়াজের দ্বারা গোর্খা লীগ নেতৃত্বের উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সফল লড়াই সম্ভব নয়। নেপালি (গোর্খা) জনগণের সামনে তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবির মূল প্রকৃতি বিশ্লেষন করে দেখানো চাই। আর চাই সেই দাবী পুরণের পথনির্দেশ। ’’

ভারতে জাতিসত্তার প্রশ্ন

প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতে কোনও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বা বিষয়ীগত জাতীয় চেতনা ছিল না। পরিচয়সত্তা (আইডেন্টিটি)-র বিষয়গত চিহ্নগুলো (যেমন একটি সাধারণ ভাষা, হরফ, একই ধরনের মানসিক গঠন, বিশ্বাসবোধ ইত্যাদি) বহন করে এমন কোনও সীমানা ছিল না। মার্কসবাদীরা সাধারণতঃ এভাবে দেখে যে, ভারত একটা দেশ বটে, কিন্তু কোনও জাতি নয়। কোনও একই ভাষা বা একইরকমের সংস্কৃতি ছিল না ভারতে। ভারত বলে একটা দেশের আবছা ধারণা ছিল খানিকটা, যার কারণ অনেকটাই ভৌগোলিক। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে মহাসাগর ঘেরা একটা আসমুদ্র হিমাচলের ধারণা হাজির হয়েছে সময়ে সময়ে। আর থেকেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি এবং ভাষা হিসেবে সংস্কৃত-র আধিপত্য। ক্রমান্বয়ে ভাষা হিসেবে সংস্কৃত, পার্সি, ইংরাজি ও তারপর হিন্দির একটা ভূমিকা থেকেছে এই ভারত ভাবনার নির্মাণে। আমির খসরুর লেখায়, ইসামির গানে, আসামের বৈষ্ণব সন্ন্যাসী মাধবদেবের বর্ণনায় যে ভারতবর্ষ বা হিন্দুস্তানের কথা শোনা গেছে, তাতে মূলতঃ পুরো উপমহাদেশের কথাই বলা হয়েছে।

ব্রিটিশরা আসার আগে মধ্যযুগের ভারতে আঞ্চলিকভাবে এক একটা জাতি ক্রমশঃ দানা বেধে উঠছিলো। ১৭-১৮ শতকের মারাঠি জনগণের মধ্যে ‘স্বরাজ্য’-এর ধারণা, তারও আগে ‘মহারাষ্ট্র-ধর্ম’-র ধারণা, শিখ রাজ্যের বিকাশ, আসামের সামন্তবাদী রাজার প্রভাব ইত্যাদি নানা চেহারায় জন্ম দিচ্ছিল ভ্রূণাকারে এক একটা জাতীয় চেতনা। ব্রিটিশ পূর্ববর্তী ভারতে এই ধারণা যেটুকু গড়ে উঠেছিলো, সেটা প্রধানতঃ বাইরের আক্রমণের মুখে, বিশেষত মুঘল আক্রমণের সামনে এরকম অনেক উদাহরণ দেখা যাবে। প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতে সমাজবিকাশের গতিপথে বুর্জোয়া বিকাশের উপাদানগুলো যেমন যেমন দেখা গেছে, তেমনভাবেই শুরু হয়েছে জাতিগঠনের প্রক্রিয়া। বুর্জোয়া বিকাশের অনুপস্থিতির ফলে এই সময়ে এসব জাতিগুলো জাতীয়তাবাদের কোনও আদর্শ বা তজ্জনিত কাঠামোগত পরিবর্তনের চিহ্নমাত্র দেখায়নি। নতুন উৎপাদিকা শক্তির সামনে তারা পড়েনি, ফলে বিকশিত হওয়ার বদলে তারা থমকে গেছে বা ক্ষয় পেয়েছে। গোষ্ঠী, সমাজ, জাত, ধর্মের বদলে উনবিংশ শতকে বুর্জোয়ারা ভাষা ও হরফের ভিত্তিতে আঞ্চলিকভাবে জনগণের ঐক্যের চেহারা দিতে শুরু করলো। যতই কাঁচা হোক, তারা রচনা করলো রাজনৈতিক কার্যক্রম, যার লক্ষ্য হল কাঙ্ক্ষিত কাঠামোগত পরিবর্তন এবং এর সপক্ষে জনগণের আবেগ গড়ে তুলতে সমর্থ হল তারা। যদিও বুর্জোয়া চেতনার এই ঢেউ শুরুতে কৃষকদের কাছে তেমনভাবে পৌঁছয়নি।

ওদিকে ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থেই রেল ও সড়কপথে জুড়তে থাকলো বিভিন্ন এলাকাকে, গড়ে তুললো একটা কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো এবং ব্রিটিশ শিল্পের সাথে সংযুক্ত একটা বিস্তৃত বাজার। একটানা দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসন ভারতে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়ে গেছে। ঐ সমগ্র পর্যায় জুড়ে ব্রিটিশ শাসন ভারতের অর্থনীতিতে পুঁজির বৃদ্ধির সাধারণ পথটি রুদ্ধ করে এক বিকৃত পথ চাপিয়ে দিয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে টিকিয়ে রেখেছিল সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক। শিল্পের কাঁচামালে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার ও তা ভারতের বাইরে (মূলতঃ ইংল্যান্ডে) নিয়ে যাওয়া, ভারতের প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধ পণ্য-বাজার (ভোগ্যপণ্য ও শিল্পদ্রব্য) বহুলাংশে দেশে আমদানিকৃত পণ্যের মাধ্যমে পুষ্ট হওয়ায় দেশে শিল্প-পুঁজির বিকাশ স্বাভাবিক গতি পায়নি। লগ্নী পুঁজির অনুপ্রবেশ, বাণিজ্যিক পুঁজির চলাচল, শিল্প-পুঁজির ধীরগতি ও বিকৃত এক বিকাশের পার্শ্বফল হিসেবে কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক অত্যন্ত ধীরগতিতে ক্ষয় পেয়েছে। ১৭৯৩ সালের কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন অবিভক্ত বাংলায় দেশীয় জমিদারদের সাথে ব্রিটিশ শাসনকর্তাদের এক সমঝোতা হিসেবে একদিকে জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিল, অন্যদিকে জমির কেনাবেচার প্রথম সূত্রপাত ঘটায়। কিন্তু কোনও ধরনের ভূমিসংস্কার কর্মসূচীই সচেতনভাবে গ্রহণ করা হয়নি, যা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে যায় ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি ও সামন্তপ্রভুদের হাতে।

মোটের ওপর, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে গিয়ে ভারতের বুর্জোয়ারা ভারতীয় জনগণের ঐক্যের বিষয়টিকে বারম্বার হাজির করে, যদিও জনগণের সব অংশের ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে একই রকম ভূমিকা বা সক্রিয়তা ছিল না। একদিকে পুঁজিপতি ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বরাজ ও স্বদেশীর স্লোগান, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী জঙ্গী কৃষকবিদ্রোহ সবসময় একই ভাবে মিলমিশ খায়নি। তবু এটা অনস্বীকার্য যে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামই সেই জাদুকাঠি, যা ‘ভারতীয়’ পরিচয়কে ক্রমশঃ শক্তিশালী করে তুলেছে, জড়ো করেছে বেশি বেশি মানুষকে, এবং সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে থাকা স্থানিক পরিচয়ের অস্মিতার ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছে ভারত নামক দেশের বোধের প্রতি আনুগত্যকে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই যত চিন্তা-চেতনা-শিক্ষায় এগিয়ে থাকা জাতি, তারা তত বেশি আলোড়িত হয়েছে এই সংগ্রামে, আরও বেশি করে গ্রহণ করেছে ভারতীয় পরিচয়কে, ভারতীয়ত্বের ভাবনাকে বহন করেছে বেশি। ব্রিটিশের আগমন আমাদের দেশে না ঘটলে ভারত নামক দেশটির হয়ত দেখাই মিলতো না, ভারতের বদলে হয়ত উদয় হত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মত অনেকগুলো জাতিরাষ্ট্রের চেহারা।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর, ১৯০৮ থেকেই ভারতে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠেছিল। ১৯১১ সালে গঠিত হল অন্ধ্র মহাসভা, আলাদা অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবি নিয়ে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন ও সর্বস্তরে শিক্ষায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের আন্দোলন গড়ে উঠছিলো তামিল, মালয়ালী, মারাঠি, গুজরাটি, বাঙালি ও উড়িয়াদের মধ্যে, ১৯১৮-১৯২২-এর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উত্তাল লড়াইয়ের যুগে। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ ধরে নিয়ে গড়ে তোলা হতে থাকলো কংগ্রেসের সংগঠন। ১৯২৯ সালে মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে নেহেরু কমিটি সাইমন কমিশনের কাছে সেই দাবি পেশ করল। কংগ্রেস সেই প্রস্তাব গ্রহণ করল, কিন্তু ব্রিটিশরা তা মেনে নিলো না। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ এই দাবিতে ক্রমশ আরও সংগঠিত হচ্ছিলেন। ১৯৩৮ সালে কর্ণাটক, অন্ধ্র আর কেরলের কংগ্রেস কমিটিগুলো তাদের জাতীয় নেতৃত্বকে চাপ দিতে থাকলো ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই দাবি পেশ করার জন্য। কংগ্রেস নেতৃত্ব সেই চাপ তো দিলই না, উল্টে ১৯৩৮-এর ২৫শে জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা ক্ষমতায় এলেই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন করবে, এখন আর এই নিয়ে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। ভারতে বহু ভাষার অস্তিত্বকে স্বীকার করলেও বহু জাতিসত্তার অস্তিত্বকে কংগ্রেস মানতে চায়নি। বিভিন্ন অঞ্চলে যখন এই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবি জোরদার হয়েছে, তখন সেখানকার কংগ্রেসি নেতারা এসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে হাজির হয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও তখনকার মত করে সেই দাবি মেনে নিয়েছে, প্রস্তাব পাশ করেছে, কিন্তু কোন কার্যকরী আন্দোলন গড়ে তোলেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে, বিভিন্ন ধর্মাচরণ করা মানুষের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, ব্রিটিশরা কিন্তু ভাষা-ধর্মের বিভিন্নতার সুযোগ নিয়ে সেই লড়াইয়ে ফাটল ধরাতে পারেনি। সেই ফাটল ধরিয়েছিল কংগ্রেস নেতৃত্ব।

বিভিন্ন জাতিসত্তার অস্মিতার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে তারা আনলো ‘এক দেশ এক জাতি’র ধারণা। আর তার পাশাপাশি হিন্দু মহাসভার নেতারা হাজির করলো ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’, মুসলিম লীগও তার পক্ষে দাঁড়ালো। আগ বাড়িয়ে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশের দাবি তুললো। এবার কংগ্রেস তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো এবং প্রথমবারের জন্য স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলল। কংগ্রেসের নেতারা বলতে শুরু করলেন, ‘যে কোন ভূখণ্ডের আত্মনিয়ন্ত্রণের এমনকি বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার’ স্বাধীন ভারতে দেওয়া হবে। গান্ধীজী বললেন, ‘অবশিষ্ট ভারতবর্ষের মত মুসলমানদেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে। যে কেউ স্বাতন্ত্র্যের দাবি করতে পারে। ’ জহরলাল নেহেরু বললেন, ‘আজকের পৃথিবীতে বৃহত্তর যুক্তরাষ্ট্র গঠনের দিকে ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানের পরিকল্পনা এই প্রবণতার বিপরীতমুখী। …সাধারণভাবে বলতে গেলে কংগ্রেস দৃঢ়ভাবে ভারতবর্ষের ঐক্যে বিশ্বাসী এবং পর্যাপ্ত স্বায়ত্তশাসন সহ যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা তার উদ্দেশ্য। …তবে দিল্লিতে কংগ্রেস খুব পরিষ্কারভাবেই একথা বলে দিয়েছে যে, কোন ভূখণ্ড যদি দৃঢ় ও স্পষ্টভাবে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে পৃথক হতে চায় তবে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে আটকে রাখা যাবে না। ’ ওদিকে হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকর, যিনি নিজে আগে দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেছিলেন, তিনিই এবার মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের বিরোধিতায় দাঁড়ালেন।

মোটের ওপর, জাতি-ভাষা-জাতিসত্তার লড়াই চাপা পড়ল ধর্ম নিয়ে শাসকদলগুলোর এই রাজনীতির আড়ালে। দেশভাগকে কেন্দ্র করে যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সৃষ্টি হল, তাতে হারিয়ে গেল জাতিসত্তাগুলোর কণ্ঠস্বর। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর বাদামি চামড়ার শাসকরা সেই সুযোগে জাতিসত্তার আওয়াজকে বিচ্ছিন্নতাবাদের সংকেত বলে অভিহিত করতে শুরু করে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবিকে অস্বীকার করল। এতে কিন্তু সমাধান হল না কিছুই। জাতিসত্তাগুলোর একের পর এক লড়াই তা দেখিয়ে দিয়েছে।

গোর্খাস্থানের দাবির কথা আগেই বলেছি। গোর্খাস্থানের দাবির পাশাপাশি এই সময় ১৯৪৫-এর প্রাদেশিক বিধানসভা নির্বাচনের সময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ‘বিশাল অন্ধ্র’, ‘ঐক্য কেরালা’ ও ‘সংযুক্ত মহারাষ্ট্র’ রাজ্য গঠনের দাবিকে সমর্থন করলো। কমিউনিস্টরা সেই সময় অন্ধ্র মহাসভার মধ্যে কাজ করছিল, ঠিক যেমনটা এখানে তারা কাজ করছিলো গোর্খা লীগের মধ্যে। সংযুক্ত মহারাষ্ট্রের দাবিতে মারাঠা সম্মেলনেও তারা যোগ দিল। নানা জায়গায় চাপে পড়ে কংগ্রেসও এই দাবিগুলোর সাথে ঢোঁক গিলে সায় দিতে বাধ্য হচ্ছিল।

এই পর্যায়ে জাতিসত্তার আন্দোলনগুলো প্রধানত গড়ে উঠছিলো সামন্ত রাজাদের অধীনে করদ রাজ্যগুলোতে। করদ রাজ্যগুলো বাস্তবত ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরেও নিজেদের দখল কায়েম করে রাখার জন্য রাজা বা সামন্তপ্রভুদের নিজস্ব ব্যবস্থা, যা ব্রিটিশের অনুগ্রহেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু জাতিসত্তার লড়াইগুলোতে ভীত হয়ে তারা বাধ্য হল নিজেদেরকে ভারতরাষ্ট্রের হাতে নিজেদের সঁপে দিতে। ফলত ভারত রাষ্ট্রের ঐক্যই সুদৃঢ় হল আর সেই আনন্দে আত্মহারা ভারতের তৎকালীন দেশীয় শাসকরা পুরনো প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গিয়ে শুরু করলো জাতিসত্তার দাবির প্রতি অবিচার। ১৯৫০ সালে তৈরি ‘স্বাধীন’ ভারতের সংবিধানে প্রদেশগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার— কিছুই রইলো না। প্রায় সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল কেন্দ্র সরকারের হাতে। আর স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক এক যুক্তরাষ্ট্রের বদলে ভারত নিজেকে তৈরি করল ‘জাতিসত্তাগুলোর এক কারাগার’ হিসেবে।

ওদিকে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি চলে গেছে বিশ বাঁও জলে। জনগণের আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হতে থাকায় ১৯৫৩ সালে ভারত সরকার রাজ্য পুনর্গঠনী কমিশন নিয়োগ করতে বাধ্য হল। এই কমিশনের কাছে বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধিরা ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন প্রদেশ গঠনের দাবিকে পেশ করলো, আর তার বিপরীতে টাটা, বিড়লা সহ বড় বুর্জোয়ারা স্পষ্টতই বিরোধিতা করলো এই দাবিকে— তারা বলল যে এর ফলে ভারতের ঐক্য দুর্বল হবে, আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদ শক্তিশালী হবে এবং ব্যাহত হবে দেশের উন্নয়ন। কিন্তু গণআন্দোলনের জেরে অনেক টালবাহানার পরেও এই কমিশন বাধ্য হল বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব দিতে। এই সমস্ত জাতিসত্তাগুলো অবশ্য সবই মোটামুটি উন্নত, ক্ষমতাভোগী জাতিসত্তা, তাদের দাবিগুলো তাই তা-ও কিছু মান্যতা পেয়েছে। কিন্তু এর বাইরে যে অনুন্নত, নিপীড়িত জাতিসত্তাগুলো রয়েছে— তাদের তো মোটেই কোন স্বীকৃতি মেলেনি। আর ভারত সরকারও এমন নীতি কার্যত নিয়েছে যে, যেমন যেমন করে এই অনুন্নত জাতিসত্তাগুলো জেগে উঠবে, তাদের দাবিদাওয়া-অধিকার চেয়ে বসবে— তার প্রতিটা ক্ষেত্রেই অবধারিত হয়ে উঠবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কেননা শাসকশ্রেণির শিখিয়ে দেওয়া আশঙ্কার বুলিগুলোই তারা আওড়ায়।

অন্য দেশের বেলায়, যে দেশগুলো বিদেশী দখলে আছে, এমন দেশের ক্ষেত্রে ভারত নিজে যেখানে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে, নিজের দেশের সীমানায় তা করে না। জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করার মানে তো স্বীকার করতে হবে কারোর বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারও। সেই ’৪৭ থেকে তাই লাগাতার চলছে বিভিন্ন জাতির লড়াই। ভারত তার নিজের সীমানার মধ্যে নতুন রাজ্য গঠনের অধিকারকে স্বীকার করে। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে কোনও অংশ কোনও রাজ্য থেকে আলাদা হতে পারে, কারোর সাথে জুড়তে পারে, আলাদাও থাকতে পারে, রাজ্যের আয়তন বদলাতে পারে। কিন্তু দেশ থেকে আলাদা হওয়াটা ভারত মানবেই না।

দার্জিলিং : ৪৭-এর পরও চললো চাপানউতোর

ক্ষমতা হস্তান্তরের ঠিক পরে ১৯৪৭-এর আগস্টেই দার্জিলিংয়ে স্বশাসনের দাবিতে একটা জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, বস্তুত দার্জিলিংয়ে বসবাসকারী সমস্ত ভাষাভাষী মানুষদের নেতাদের উদ্যোগে। ১৯৫২ তে কালিম্পংয়ে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সফরে এলে গোর্খা লীগের পক্ষ থেকে তার কাছে দাবিপত্র পেশ করা হয়, যাতে ১৯০৭ থেকে চলে আসা দাবিগুলির বিষয়ে বিশদে লিখে তারা তিনটি বিকল্প প্রস্তাব হাজির করে: ক) জেলার জন্য পৃথক প্রশাসনিক ইউনিট যা কেন্দ্রের অধীনে থাকবে, খ) দার্জিলিং ও আশপাশের এলাকা নিয়ে একটা আলাদা রাজ্য, গ) দার্জিলিংয়ের সাথে জলপাইগুড়ির অংশবিশেষ অর্থাৎ ডুয়ার্সকে নিয়ে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হোক।

উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুকে একটি চিঠিতে লিখলেন,

“উত্তরে এবং উত্তর-পূর্বে সমগ্র হিমালয়ের জুড়ে সীমানার এপারে এমন একটা জনসংখ্যা আছে, যারা নৃতাত্ত্বিক এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে তিব্বতীয় ও মঙ্গোলীয়দের থেকে আলাদা নয়। এই সীমানার অবিন্যস্ত অবস্থা এবং আমাদের দিকে এরকম একটা জনসংখ্যা থাকা, যাদের আসক্তি আবার তিব্বতীয় বা চৈনিকদের দিকে, এরা চীন ও আমাদের মধ্যে গন্ডগোলের উত্স হয়ে ওঠার সমস্ত উপাদান বহন করছে। সাম্প্রতিককালের এবং তিক্ততায় ভরা অতীত ইতিহাস এটাও আমাদের বলে যে, কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো ঢাল নয় এবং কমিউনিস্টরাই সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে কোনভাবেই আলাদা নয়।

…এই এলাকাগুলোর সাথে আমাদের সংযোগটা কোনভাবেই ঘনিষ্ঠতার বা বিশ্বাসযোগ্যতার নয়। এই অংশে বসবাসকারীদের ভারতের প্রতি কোনো গভীর আনুগত্য বা একাগ্রতা নেই। এমনকি দার্জিলিং বা কালিম্পংয়ের মত এলাকাগুলোও মঙ্গোলীয়দের পক্ষের অনুভুতি থেকে মুক্ত নয়।”

১৯৫৫ সালে দার্জিলিং থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত এন বি গুরুং অভিযোগ করেন যে, পশ্চিমবঙ্গের সরকার এবং কংগ্রেস দল দার্জিলিংয়ের জনতার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করছে। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে কংগ্রেসের পেশ করা এক দাবিপত্রের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন,

“দার্জিলিংয়ে নেপালি-ভাষী মানুষ ২০%, বাংলাভাষী ১৪.৩%, হিন্দিভাষী ৬.৮%, লেপচা ও ভুটিয়া ৪%, মোট ৪৫.১%। এটা বোঝা গেল না যে বাকি ৫৪.৯% কারা? নিশ্চয়ই তারা চীনা নয়!”

রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, যে কোন রাজ্যের একটি অঞ্চলে যদি ৭০%-এর বেশি মানুষ একই জনজাতির বা একই ভাষাভাষী হন, তাহলে তাদেরকে ওই রাজ্যে সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের সেই ভাষা হবে ওই অঞ্চলের সরকারী ভাষা। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন সেনসাসের তথ্য থেকে তাদের সিদ্ধান্ত তৈরির জন্য রসদ নিয়েছে। যে সেনসাসের ওপর দাঁড়িয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে, ১৯৫১-র সেই সেনসাস রিপোর্টকে বিকৃত করা হল, দার্জিলিং জেলার মোট নেপালি-ভাষী মানুষ ৮৮, ৯৫৮ জন অর্থাৎ ১৯.৯৬% বলে দেখানো হল। ঠিক তার পরের বারের সেন্সাসে এই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছিল ৯৪%, আর আগে ১৯২০ তে পাহাড়ে আলাদা প্রশাসনিক কাঠামোর যে দাবিপত্র পেশ করা হয়েছিল, তাতেও ছিল যে ‘এখানকার জনসংখ্যা নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার মত’। কিভাবে তাহলে এই তারতম্যটা হল? ঐ সেন্সাসে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ, ছেত্রী ও তফসিলি জাতির মানুষদেরই নেপালি বলে ধরা হল, বাকি বহু বিভিন্ন বর্ণের নেপালিদের (রাই, লিম্বু, খাম্বু ইত্যাদি) তাদের স্ব স্ব বর্ণগত পরিচয়কে আলাদা আলাদা ভাষা ধরা হল।

১৯৫৫ সালে নেপালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি, দার্জিলিং পাহাড়ের জন্য স্বশাসন ও চা শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির কথা বিধানসভায় পেশ করেন জ্যোতি বসু। ওই বছরই দার্জিলিং পাহাড়ের মার্গারেটস হোপ চা বাগানে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠলে তার ওপর গুলি চালায় পুলিশ। গোর্খা লিগের ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক সংঘ এবং কমিউনিস্ট পার্টির মজদুর ইউনিয়ন ১৯৫৫-র ৮ই মার্চ চা বাগান মালিক ও সরকারের কাছে একটি দাবিপত্র পেশ করে। তাদের প্রধান দাবি ছিল ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের সমান বেতন, লাভের ভিত্তিতে বোনাস দান, স্ট্যান্ডিং অর্ডারে সংশোধন আনা, ম্যানেজমেন্টের খেয়ালখুশি মত শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের নিয়ম বাতিল ইত্যাদি। ম্যানেজমেন্ট বা সরকারের যথারীতি কোন হেলদোল নেই। সরকারে তখন বিধানচন্দ্র রায়ের কংগ্রেস। ৯ই জুন গোর্খা দুঃখ নিবারক সম্মেলনে একটা মিটিং করে ইউনিয়ন দুটি সিদ্ধান্ত নেয় যে ২২শে জুন থেকে লাগাতার স্ট্রাইক শুরু করা হবে। নানা আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু তার কোন সদর্থক ফল হয়নি। ২০শে জুন সমস্ত নেতাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরোয়। অনেকে গ্রেফতার হন, কেউ কেউ আত্মগোপন করেন। ২৫ জুন ৩টের সময় মার্গারেটস হোপ চা বাগানে শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়— অমৃতা কামিনি (১৮), মৌলিশোভা রাইনি (২৩ বছর এবং তিনি গর্ভবতী ছিলেন তখন), কাঞ্চা সুনুয়ার (২২), পদমবাহাদুর কামি (২৫), কালে লিম্বু (১৪), জিতমান তামাং শহিদ হন। ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে ২৭ জুন তাদের শবযাত্রায় তিরিশ হাজার মানুষ একত্রিত হন।

১৯৫৮-র মার্চে যখন এরাজ্যের জন্য বাংলাকে সরকারী ও প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার জন্য বিল পেশ হয়, তখন কমিউনিস্ট পার্টির বি বি হামাল পাহাড়ের সরকারী ভাষা হিসেবে নেপালির স্বীকৃতির দাবি তোলেন। এন বি গুরুংও তার পক্ষে জোরদার সওয়াল করেন, এবং অবশেষে ওই বিলে পাহাড়ের সরকারী ভাষা হিসেবে নেপালিকে স্বীকৃতি দেয়। ভাষার স্বীকৃতি তো হল, কিন্তু স্বশাসন? দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব, কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতৃত্ব, অন্যান্য স্থানীয় দলগুলো লাগাতার আলাদা রাজ্য, স্বশাসন ইত্যাদি দাবি করে গেলেও তাদের উচ্চতর নেতৃত্ব হয় সেটা নাকচ করেছে, দাবী নিয়ে টালবাহানা করেছে এবং সমস্ত সরকারই নস্যাৎ করে দিয়েছে। ১৯৬৭তে যুক্তফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরও তার কোন অন্যথা হয়নি। পাহাড় থেকে নির্বাচিত গোর্খা লীগের নেতা ডি পি রাই এই সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯-দুবারই। ১৯৭৩-এ সিপিএম ও গোর্খা লীগ একটি দলিল রচনা করে ‘প্রোগ্রাম এন্ড ডিমান্ড অফ অটোনমি’, যা একটা স্বশাসিত জেলা পরিষদের দাবীকে রাখে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানায় দার্জিলিংয়ের জন্য একটা হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল গঠিত হয়। পাহাড়ের মানুষের জন্য এটা প্রথম সরকারীভাবে স্বীকৃত আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হলেও বাস্তবত মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে তা ব্যর্থ হয়।

আশির দশকে

১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পরও পুরনো ব্যবস্থাপনাই চলতে থাকলো। মানুষ কিন্তু অস্থির হয়ে উঠছিলো। পাহাড়ের চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী মানুষদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘প্রান্ত পরিষদ’। পৃথক রাজ্যের দাবি নিয়ে তারা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্মারকলিপি জমা দেয়। ১৯৮১-র ৭ই সেপ্টেম্বর দার্জিলিংয়ের চকবাজারে গুলি চলে তাদের আন্দোলনে। ব্যাপক দমনপীড়নের মুখে শেষ হয়ে যায় প্রান্ত পরিষদ। অখিল ভারতীয় নেপালি ভাষা সমিতিও এই সময় ভারতের সংবিধানে নেপালি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন গড়তে থাকে। ঐ সময়ই গড়ে ওঠে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জিএনএলএফ)। প্রান্ত পরিষদের তোলা আলাদা রাজ্যের দাবি সফলভাবে ঢেউ তুললো জিএনএলএফের হাতে, ১৯৮৬তে। তারপর এক রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের পর্ব। সিপিএম বনাম জিএনএলএফ। দু’বছর বাদে বহু প্রাণ যাওয়ার পর, অদৃষ্টপূর্ব হিংসা-হানাহানির পর গঠিত হল দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ বা ডিজিএইচসি, পরে যা ডিজিএইচএসি নামে পরিচিত হয়, অর্থাৎ যুক্ত হয় অটোনমাস কথাটা (২০০৫-এ আবার সেই কথাটা বাদও দেওয়া হয়)।

এত রক্তক্ষয় দিয়ে কেন তা আদায় করতে হল তা এক জটিল প্রশ্ন। ১৯৮৫ তে সিপিএমের পাহাড়ের সাংসদ আনন্দ পাঠক একটা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন সংবিধান সংশোধন চেয়ে, যাতে একটা স্বশাসিত পর্ষদ গড়া যায়। আশ্চর্যের কথা যে এই প্রস্তাব তিনি পেশ করেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে, দলের পক্ষ থেকে নয়। প্রস্তাবটি ৪৭-১৭ ভোটে পরাজিত হয়। অথচ ওই সংসদে সিপিএমের ২২ জন সহ বামফ্রন্টের সাথে যুক্ত সাংসদের সংখ্যা ছিল ৩৩! দল সমর্থন দিল না আনন্দ পাঠকের প্রস্তাবে। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বদলে আঞ্চলিক স্বশাসনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ১৯৫১ সালে, ১৯৭২-এর সিপিএমের মাদুরাই পার্টি কংগ্রেসে সে বিষয়ে বিশদে নীতি তৈরি হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল—

“এরকম বাধ্যতার কোনো কারণ নেই যে এই স্লোগানকে আমাদের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, এবং তাও এমন সময়ে যখন ভারতের জাতিসত্ত্বাগুলোকে আমরা নিপীড়ক আর নিপীড়িত বলে বিভাজন করতে পারছি না, এবং যখন একদিকে বড় বুর্জোয়া-জমিদারদের সরকার আর অন্যদিকে বিভিন্ন জাতির নানা উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উস্কানিদাতা শক্তিগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধ্বংসকামী শক্তিগুলোকে মদত দেওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যকে বিপন্ন করছে, এবং অতঃপর সর্বহারার পার্টির সামনে সর্বাগ্রগণ্য কাজ হিসেবে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াইকেই মুখ্যতঃ হাজির করছে।”

সিপিএম দলের ভিতরে যে জাতি প্রশ্নে ভয়াবহ দৈন্য জমতে থেকেছে, তা দিনদিন তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হতে থেকেছে, তাদের বাস্তব কর্মকৌশলে আর এমনকি তাদের তাত্ত্বিক বোঝাপড়াতেও। নইলে স্বশাসন মানতেও তাদের এত আপত্তি কেন? বিশেষতঃ যখন ১৯৫১-র কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও স্বশাসনের পার্থক্যের ব্যাপারে সুস্পষ্ট আলোচনার মধ্যে দিয়ে স্বশাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল কম্যুনিস্ট পার্টি?

জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারমার্কসবাদ যা বলছে

আলাদা দেশ, আলাদা রাজ্য… বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার বিষয়ে, নিপীড়িত জাতিসত্তাসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়ে ক্রমশ পিছু হটতে থেকেছে এদেশের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ধারাবাহিকতায় মূলধারার বামপন্থী পার্টিগুলো। পরের দিকে দাবি কেন্দ্রীভূত হয় মূলত স্বশাসনের, এবং তারপর চলেছে সেই নিয়েও টালবাহানা। আর কমিউনিস্ট বিপ্লবী শক্তি বলে পরিচিত যারা, তারা সাধারণতঃ নিঃশর্ত সমর্থনের হাত বাড়িয়েছে নিপীড়িত জাতিসত্তার আন্দোলনগুলোর প্রতি। দুটো অভিমুখে দুটো চরম প্রবণতা, অথচ আন্তর্জাতিকভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলন কিন্তু এপ্রশ্নে বিশদে তাদের আলোচনা নথিবদ্ধ করেছে, অবহেলা নয়— বরং সমধিক গুরুত্বের সাথে, শ্রেণি আন্দোলনের বিকাশের সাথে সম্পর্কিতভাবে দেখেছে জাতি প্রশ্নকে। এই সুযোগে সংক্ষেপে সেই আলোচনায় ঢোকা যাক।

কিভাবে গড়ে উঠলো জাতি?

ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজের বিকাশকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কসবাদীরা কীভাবে দেখে জাতির বিকাশকে? সভ্যতা বিকাশের শুরুতে জাতি ছিল না। আদিম সমাজে মানুষ তুলনামূলক ছোট কোনও সমষ্টির (ক্ল্যান) মধ্যে বা কতকগুলো এরকম সমষ্টি একত্রিত হয়ে বসবাস করত, যার ভিত্তিই ছিল আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্ক। এরা পরিচিত ছিল উপজাতি বা ট্রাইব হিসেবে। সমাজ ব্যবস্থার বিকাশের সাথে সাথে, ট্রাইবগুলো মিশে যায় এবং জন্ম নেয় জাতি। কোনও জাতির সদস্যরা আর শুধুমাত্র রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত নয়, এবং সাধারণভাবে জাতি তৈরি হল বিভিন্ন বর্ণগত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ট্রাইবগুলোর একীকরণের মধ্যে দিয়ে। এই জাতিগুলি একই ভাষায় কথা বলে, থাকেও সাধারণত একই এলাকায়। তাদের রয়েছে একই ধরনের সংস্কৃতি এবং মানসিক গঠন। যদিও দাসপ্রথা এবং সামন্ততন্ত্রের যুগে, দাস মালিক বা জমিদারদের রাজত্ব এবং আইন-কানুনগুলো তখনো পর্যন্ত ছিল কমবেশি স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই বিভিন্ন জাতিগুলো গড়ে উঠেছিলো বিচ্ছিন্ন সমষ্টিগুলোকে নিয়ে যাদের মধ্যে কোন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বাঁধুনি ছিল না।

পুঁজিবাদের বিকাশ সৃষ্টি করে আধুনিক জাতি। একইরকম পণ্য উৎপাদন, অর্থনৈতিক দক্ষতা, এবং সমগ্রটা জুড়ে বাণিজ্য ও যোগাযোগ জাতিগত অর্থনৈতিক ঐক্য তৈরি করে, এবং একটা কেন্দ্রীভূত জাতি রাষ্ট্রের প্রয়োজনকে হাজির করে। জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা সাধারণভাবে পুঁজিবাদী বিকাশের সাথে সম্পর্কিত। এপ্রসঙ্গে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটা লেনিন এভাবে সংক্ষেপে রেখেছেন—

“গোটা বিশ্বজুড়েই, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয়ের সমগ্র পর্যায়টাই জাতীয় আন্দোলনগুলোর সাথে সম্পর্কিত। পণ্য উত্পাদনের সম্পূর্ণ বিজয়ের জন্য বুর্জোয়াদের দিক থেকে আভ্যন্তরীন বাজার কব্জা করতে হয়, এবং রাজনৈতিক ভাবে একীভূত ক্ষেত্র দরকার যেখানকার মানুষরা একই ভাষায় কথা বলে… এর মধ্যেই রয়েছে জাতীয় আন্দোলনগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি”। (জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, লেনিন))

স্তালিন সুসংহতভাবে চিহ্নিত করছেন কাকে বলে জাতি। জাতির সংজ্ঞা বোঝার জন্য স্তালিনের পেশ করা আলোচনাটা একটু বিস্তৃত ভাবে উদ্ধৃত করা যাক—

“জাতি কী?

জাতি প্রথমতঃ একটা জনগোষ্ঠী (community), একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ।

এই জনগোষ্ঠী একই বংশ বা বর্ণ উদ্ভূত জনগোষ্ঠী (racial) নয়, কৌমও (tribal) নয়। আধুনিক ইতালীয় জাতি রোমান, টিউটন, এট্রুস্কান, গ্রীক, আরবীয় এবং আরও অন্যান্যদের নিয়ে তৈরী হয়েছে। ফরাসি জাতি তৈরী হয়েছে গল, রোমান, ব্রাইটন, টিউটন ও আরও অন্যান্যদের নিয়ে। একই রকম কথা ব্রিটিশদের সম্পর্কে বলা যায়, বলা যায় জার্মানদের সম্পর্কে, যারা জাতি হিসেবে গঠিত হয়েছে বিভিন্ন বংশ বা বর্ণ উদ্ভূত জনগোষ্ঠী (race) ও কৌম (tribe)-এর মানুষদের নিয়ে।

অতঃপর, জাতি একই বংশ বা বর্ণ উদ্ভূত জনগোষ্ঠী নয়, কৌমও নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবে গঠিত মানুষের জনগোষ্ঠী।

অন্যদিকে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, সাইরাস এবং আলেক্সান্ডারের বিশাল সাম্রাজ্যকে কোনভাবেই জাতি বলা চলে না, যদিও এগুলো ঐতিহাসিকভাবে তৈরী হয়েছে, এবং গঠিত হয়েছে বিভিন্ন বংশ বা বর্ণ উদ্ভূত জনগোষ্ঠী এবং কৌমদের নিয়ে। এগুলো জাতি ছিল না, বরং বলা যায় এগুলো ছিল পরিকল্পনাহীন এবং ঢিলেঢালাভাবে সংযুক্ত সমষ্টিগুলোর জোট, যারা বিভিন্ন রাজ্যাবিজেতাদের জয় বা হারের ফলে ছিটকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল বা সংযুক্ত হয়েছিল।

অতঃপর, জাতি কোনো এলোমেলো বা ক্ষণস্থায়ী  জোট নয়, বরং মানুষের একটা সুস্থায়ী জনগোষ্ঠী।

কিন্তু সব সুস্থায়ী জনগোষ্ঠীই একটা জাতি গঠন করে না। অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়াও সুস্থায়ী জনগোষ্ঠী, কিন্তু তাদেরকে কেউ জাতি বলে না। একটা রাষ্ট্রীয় জনগোষ্ঠী থেকে একটা জাতিগত জনগোষ্ঠী কোথায় আলাদা? আরো নানা কারণের মধ্যে এই বাস্তবতাটা আছে যে, একটা জাতিগত জনগোষ্ঠী একটা সাধারণ ভাষা ছাড়া ভাবা যায় না, অথচ একটা রাষ্ট্রের কোনো সাধারণ ভাষা থাকতে হবে, কথাটা মোটেই এমন নয়। অস্ট্রিয়াতে চেক জাতি এবং রাশিয়াতে পোলিশ জাতির অস্তিত্ব অসম্ভব হত, যদি তাদের একটা নিজেদের একটা করে সাধারণ ভাষা না থাকতো, আর অন্যদিকে রাশিয়া আর অস্ট্রিয়ার সীমানার মধ্যে অনেকগুলো আলাদা আলাদা ভাষা থাকা সত্ত্বেও সেই দেশগুলোর ঐক্যের কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। আমরা অবশ্যই এখানে মানুষের কথ্য ভাষার কথা বলছি, আনুষ্ঠানিক সরকারী ভাষার কথা নয়।

অতএব, একটা সাধারণ ভাষা একটা জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন।

এর মানে, অবশ্যই এমনটা নয় যে, আলাদা জাতিগুলো সবসময় সবজায়গায় আলাদা ভাষাতেই কথা বলে, এবং একই ভাষাতেই যারা কথা বলে তারাই একটা জাতি গঠন করে। একটা জাতির জন্য একটা সাধারণ ভাষা ঠিকই, কিন্তু সবসময় আলাদা জাতির জন্য আলাদা ভাষাই থাকবে এমন কোনো কথা নেই। এমন কোন জাতি নেই যারা একই সময়ে একাধিক ভাষায় কথা বলে, কিন্তু এর মানে এমনটা নয় যে দুটো জাতি একই ভাষায় কথা বলতে পারে না। ইংরেজ ও মার্কিনরা এক ভাষায় কথা বলে, কিন্তু তারা একটাই জাতি নয়। একই কথা নরওয়েজিয়ান ও ড্যানিশ বা ইংরেজ ও আইরিশদের নিয়েও খাটে।

কিন্তু কেন, ধরা যাক, ইংরেজ ও মার্কিনরা একই ভাষায় কথা বললেও তারা একটাই জাতি নয়?

প্রথমতঃ, তারা একসাথে বসবাস করে না, আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে তাদের বসবাস। একটা জাতি তৈরী হয় কেবলমাত্র একটা দীর্ঘ ও সুব্যবস্থিত আন্তঃসম্পর্কের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই। কিন্তু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একসাথে থাকতে পারেনা যদি না তাদের একটা সাধারণ সীমানা থাকে। ইংরেজ ও মার্কিনিদের আসলে একটাই সাধারণ বাসস্থানের ক্ষেত্র ছিল, ইংল্যান্ড, এবং তখন তারা একটাই জাতি গঠন করেছিল। পরে, ইংরেজদের একটা অংশ নতুন ভূখন্ডে, আমেরিকাতে চলে যায়, এবং সেখানে, নতুন বসবাসের অঞ্চলে, সময়ের সাথে সাথে মার্কিন জাতি গঠিত হল। ভুখন্ডের পার্থক্য আলাদা আলাদা জাতির জন্ম দিল।

অর্থাৎ, একটা সাধারণ সীমানা হল একটা জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

কিন্তু এটাই সব নয়। একটা সাধারণ সীমানা মানেই তা একটা জাতি গঠন করে দেয় না। এর জন্য এছাড়াও দরকার একটা আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বাঁধুনি যা জাতির বিভিন্ন অংশকে একসাথে বেঁধে রাখে। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মধ্যে এরকম কোনো বাঁধুনি নেই, তাই তারা আলাদা আলাদা জাতি গঠন করে। কিন্তু মার্কিনিদেরও একটা জাতি বলা যেত না যদি না আমেরিকার বিভিন্ন অংশ তাদের মধ্যে শ্রমবিভাজনের কারণে, যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর উন্নতির কারণ সহ আরও নানা কারণে একই অর্থনৈতিক বাঁধুনিতে বাঁধা না থাকতো।

যেমন ধরুন, জর্জিয়ানদের কথা ধরা যাক। জর্জিয়ানরা পুনর্বিন্যাসের আগে একটা সাধারণ ভুখন্ডে থাকতো এবং একটাই ভাষা বলতো। তাসত্ত্বেও, সত্যি কথা বলতে গেলে, তারা একটা জাতি গঠন করেনি, কেননা, তারা কতকগুলো বিচ্ছিন্ন রীতিনীতি দ্বারা বিভাজিত ছিল, তাদের একটা একই রকমের অর্থনৈতিক জীবন ছিল না; কোনো কোনো সফল রাজা যারা কখনো সখনো সাময়িক ও জোড়াতালি দেওয়া রীতিনীতির ঐক্য তৈরী করতে পেরেছিলেন, সেটাও হয়েছিল বড়জোর উপর উপর একটা প্রশাসনিক স্তরে, এবং ভেঙ্গেও গিয়েছিল সেরকমই তাড়াতাড়ি রাজপুত্রদের খামখেয়ালিপনা এবং কৃষকদের ঔদাসীন্যের কারণে। অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন জর্জিয়াতে অন্য কিছু হওয়ারও ছিল না… জর্জিয়া জাতি হিসেবে দেখা দিল এসে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে, যখন দাস ব্যবস্থার পতন, দেশের অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং পুঁজিবাদের বিকাশ জর্জিয়ার বিভিন্ন জেলাগুলোর মধ্যে শ্রমবিভাজন তৈরী করলো, রীতিনীতির অর্থনৈতিক বিভাজনগুলোকে ভেঙ্গে দিলো সম্পূর্ণভাবে এবং তাদেরকে একইসাথে জুড়ে দিলো।

একই কথা বলতে হয় সেসব জাতিগুলোর ক্ষেত্রে যারা সামন্ততন্ত্রের পর্বের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পুঁজিবাদে বিকশিত হয়েছে।

অর্থাৎ, একটা সাধারণ অর্থনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক বাঁধুনি হল জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

কিন্তু এটাও এমনকি সব নয়। আরও এগনোর আগে আমাদের হিসেবে আনতে হবে কোনো জাতি যে মানুষদের নিয়ে তৈরী হচ্ছে তার নির্দিষ্ট মানসিক গঠনকে। জাতিগুলো তাদের জীবনযাত্রার ধরণে শুধু আলাদা নয়, তারা মানসিক গঠনের দিক থেকেও আলাদা, যা জাতির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যদি ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও আয়ারল্যান্ড, যারা একই ভাষা বলে, তারা অন্ততঃ তিনটে আলাদা জাতি গঠন করেছে, ভিন্নধরনের জীবনযাত্রার কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে নিজস্ব মানসিক গঠন তাদের তৈরী হয়েছে এই ভিন্ন জাতিগঠন স্পষ্টতই তার ফলশ্রুতি।

অবশ্যই, মানসিক গঠন বা অন্যভাবে বললে ‘জাতিগত বৈশিষ্ট্য’ এমনিতে পর্যবেক্ষকের কাছে অধরা একটা ব্যাপার, কিন্তু এটা যেভাবে এটা সাধারণভাবে একটা জাতির নির্দিষ্ট সংস্কৃতি হিসেবে প্রকাশিত হয়, সেটা খানিক ধরাছোঁয়া যায়, এবং এটাকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘জাতিগত বৈশিষ্ট্য’ এমন একটা ব্যাপার যা মোটেই চিরন্তন নয়, জীবনযাত্রার ধরণের পার্থক্যের সাথে এর পরিবর্তন হতে থাকে; কিন্তু যেহেতু এটা প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো অস্তিত্ব নিয়ে থাকে, এটা জাতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের (physiognomy) ওপর ছাপ রেখে যায়।

অর্থাৎ, একটা একই ধরণের মানসিক গঠন, যা একই ধরণের সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়, তাও জাতির একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

আমরা এবার জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য চিত্রায়িত করার কাজ শেষ করে এনেছি।

একটা জাতি হল ঐতিহাসিকভাবে গঠিত, জনগণের সুস্থায়ী জনগোষ্ঠী, যা গড়ে উঠেছে একই ভাষা, একই সীমানা, একই অর্থনৈতিক জীবন, একই মানসিক গঠন যার প্রকাশ ঘটছে একই সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে— এসবের ভিত্তিতে।

এটা না বললেও চলে যে, প্রত্যেকটা ঐতিহাসিক ঘটনার মত, এটাও পরিবর্তনের নিয়মে চলে, এরও ইতিহাস আছে, আছে শুরু এবং শেষ।

এটা জোর দিয়ে বলার দরকার যে, উপরে বলা বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটাকেই পৃথকভাবে নিলে তা জাতিকে সংজ্ঞায়িত করে না। এবং এও বলার দরকার যে, এর মধ্যে কোন একটা বৈশিষ্ট্যের অভাব ঘটলে সেই জাতি আর একটা জাতি থাকে না।

এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, একই ‘জাতিগত বৈশিষ্ট্য’ সম্পন্ন জনগণ কোনভাবেই একটা জাতি হতে পারে না যদি তারা অর্থনৈতিকভাবে আলাদা হয়, ভিন্ন ভুখন্ডে থাকে, আলাদা ভাষায় কথা বলে ইত্যাদি। সেরকম রয়েছে, উদাহরণ হিসেবে, রাশিয়ান, গ্যালিসিয়ান, মার্কিন, জর্জিয়ান, এবং ককেশীয় পার্বত্য এলাকার ইহুদিরা, যারা আমাদের মতে, একটা একক জাতি বলা চলে না।

এটাও বোঝা যায় যে, একই সীমানা ও অর্থনৈতিক জীবনে থাকা মানুষরা একটা একক জাতি গঠন করে না যদি তাদের একই ভাষা ও ‘জাতিগত বৈশিষ্ট্য’ না থাকে। এরকম উদাহরণ হল জার্মানরা বা বাল্টিক অঞ্চলের লেটরা।

শেষতঃ বলা যায়, নরওয়েজিয়ান এবং ড্যানিশরা একই ভাষায় কথা বলে, কিন্তু তারা একটা একক জাতি গঠন করছে না অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোর অভাবের কারণে।

যখন এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলো উপস্থিত থাকে, তখনই আমরা তাকে একটা জাতি বলতে পারি”।

যখন আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর জন্ম হয়নি, এমন একটা সময়ই সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের শর্তাধীনে সেই সব জায়গায় জাতি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, অথবা এখনও বিকশিত হচ্ছে। অনেক সময় এই নিপীড়িত জাতিসত্তাগুলো প্রতিকূলতার মধ্যে জাতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে বা উঠছে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদের চাহিদার চাপে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিকাশ বিকৃত হয়ে গেছে। পশ্চিম ইউরোপের সংহত সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রগুলিতে জাতীয় চেতনা উদ্ভাস প্রথম দেখা যায়, তখন এইসব দেশে সামন্ততন্ত্র নির্মূল হওয়ার এবং পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়া চলছিল। উদীয়মান বুর্জোয়া বিকাশের সামনে তখন সামন্ততন্ত্রের দেশজ গণ্ডিগুলোকে পেরিয়ে গিয়ে মুক্তবাজারের হাতছানি, তাই তাদের দিক থেকে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকভাবে একটা একীকৃত বা একীকরণযোগ্য এলাকাকে চিহ্নিত করার তাগিদ ছিল, যার পিছনে থাকবে জনসমর্থনও। সাধারণভাবে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভাষা এরকম বাজার গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে দাঁড়ালো। একীকরণের শর্ত তৈরির জন্য দরকার সমষ্টির ইচ্ছা ও সচেতন উদ্যোগ— উদীয়মান বুর্জোয়ারা তাই রাজনৈতিকভাবে তাদের নিজেদের লোকজনকে নিজেদের সংস্কৃতি-রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করলো, এবং সফলও হল। তার জন্য নতুন নতুন মিথ খুঁজে বের করা, নানা লব্জ ও চিহ্ন ব্যবহার করে এই পরিচয়ের সচেতনতাকে একটা শক্তিশালী ও কার্যকরী আবেগে পরিণত করলো। এটাই জাতীয়তাবোধ। এটাই নতুন বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতায় বসার অন্যতম তুরুপের তাস। জাতীয় আন্দোলন ভেঙ্গে দিলো সামন্ততন্ত্রের বন্ধন। এর পরিণতিতে গড়ে উঠলো জাতিরাষ্ট্র এবং মুক্ত জাতীয় বাজার, যে দুটোরই বাইরের চাপ থেকে সুরক্ষা দরকার। কিছুটা ভিন্নতা সহ একই প্রক্রিয়া দেখা গেল উপনিবেশে পরিণত হওয়া দেশগুলোতে। সেখানে জাতীয় আন্দোলনগুলো গড়ে উঠেছে মূলতঃ সেই সময়ের পুঁজিবাদী বিকাশের রাস্তাকে পরিষ্কার করতে, উপনিবেশ যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে জাতীয় আন্দোলনগুলো ছিল দেশপ্রেমের থেকে আরও বেশি কিছু এবং এখনও তাই আছে। পশ্চিম ইউরোপের বাইরে কম বিকশিত ও পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে, যেখানে আর্থিক অনগ্রসরতা আরও বেশি, সেখানে জাতীয় আন্দোলনগুলোরও মূল চেহারা এরকমটা হলেও, এখানে আরও কিছু অন্য বৈশিষ্ট্যও তার মধ্যে আছে। এখানে সামন্তবাদের সাথে আপোষ আছে, তথাকথিত অভিজাত ও আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতা আছে, ফলে অনেকসময় জন্ম নিয়েছে কর্তৃত্ববাদও। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এখানে যতটা প্রবল, ততটা প্রবল থাকেনি সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম। এছাড়া বহু জাতির রাষ্ট্রে, জাতীয় আন্দোলন নানা রকম আকবাঁক নিয়েছে, যা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সাথে তুলনীয় নয় মোটেই। সেই দেশের বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, ও কৃষকরা জনগণের নেতৃত্ব দেওয়ার বেলায়, তাদেরকে সমাবেশিত করতে গিয়ে আন্দোলনের নানা ধরণ ও রাস্তা গ্রহণ করেছে। একই জাতীয় আন্দোলনের মধ্যেই থাকতে পারে আলাদা আলাদা পর্যায়। আন্দোলনের নেতৃত্ব বদলে বদলে যেতে পারে এক এক শ্রেণির হাতে। ফলে এভাবেই, কখনো কৃষকরা, কখনো শ্রমিক-কৃষক জোট এই আন্দোলনের রাশ ধরেছে। এবং একদা উদীয়মান বুর্জোয়াদের অস্ত্র জাতীয়তাবাদের মোড় ঘুরেছে সমাজতন্ত্রের দিকে। যেখানে তা হতে পারেনি, সেখানে রাশ গিয়েছে বুর্জোয়াদের হাতে— বিশ্ব পুঁজির সাথে, সাম্রাজ্যবাদের সাথে সম্পর্কক্রমে সেই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছে।

জাতিগত নিপীড়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার

“ …জাতিগত উত্পীড়ন হল সাম্রাজ্যবাদী চক্রগুলোর দ্বারা চালানো একটা শোষণের ব্যবস্থা এবং নিপীড়িত জনগণের ওপর একটা লুঠতরাজ, নিপীড়িত জনজাতির অধিকারগুলোর ওপর একটা বলপূর্বক প্রতিবন্ধকতা চাপানোর পদ্ধতি। এগুলোকে একসাথে ধরলে সামগ্রিক নীতিগুলোকে জাতিগত উত্পীড়নের নীতি বলা যেতে পারে” (স্তালিন, জাতি প্রশ্ন সম্পর্কে প্রতিবেদন, আরএসডিএলপি (বলশেভিক)-এর ৭ম কংগ্রেস)

জাতিগত উৎপীড়ন নানা চেহারা নিতে পারে। কোথাও সেটা ভাষাগত, কোথাও সেটা দাঙ্গা বা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের চেহারায় দেখা দিতে পারে। জাতিগত উৎপীড়নকে সমর্থন করে বসে দমনকারী জাতির পক্ষে তাদের জমিদার ও বুর্জোয়ারা, পেটি-বুর্জোয়া এবং শ্রমজীবী মানুষেরও একটা অংশ, এবং এরা প্রত্যেকেই প্রায় জাতিগত উৎপীড়নের মধ্যে দিয়ে বস্তুগতভাবেই লাভবান হতে। এটা পরিষ্কার যে দমনকারী জাতির একটা ক্ষুদ্র অংশের লাভের জন্য চলতে থাকে এই জাতিগত উৎপীড়ন। আর তাতে তারা সামিল করার চেষ্টা করে দমনকারী জাতির গোটাটাকে। পিছিয়ে থাকা জাতি তো তার নিজের লড়াইয়ে ছিলই। দমনকারী জাতি তার ক্ষুদ্র অংশের স্বার্থে সমগ্র জাতি জুড়ে বিদ্বেষ রচনা করতে, প্রয়োজনে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতেও পিছপা হয়না। অধিকারের লড়াই তখন প্রায়শই অকারণ খুনোখুনি বা আপোষ অথবা উগ্রপন্থার কানাগলিতে হারিয়ে যায়।

জাতিসত্তার লড়াইকে সাধারণত নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় বুর্জোয়ারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা নিপীড়ক জাতির বুর্জোয়াদের সাথে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়, স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর দখল কায়েম করার জন্য। আর তারই ফল দাঁড়ায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি। এই দাবি কেবল তখনই শক্তিশালী হতে পারে যখন সেখানে বাস্তবত তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রকাশগুলো রুদ্ধ হচ্ছে এবং তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেই অঞ্চলে স্তব্ধ হয়ে আছে। এমনটা হলে সেই সমাজের সর্বস্তর থেকে মানুষ নিজেদেরকে নিপীড়কদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রামে নামে। তাহলে এখানে মুক্তির সংগ্রামটা একই সাথে আধিপত্যকারী জাতির অত্যাচারী শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আর তাই গণতন্ত্রপ্রিয় সমস্ত মানুষের পক্ষে এই লড়াইগুলোকে সমর্থন জানানো উচিত। এবং, এটাও জরুরি যে, এই সমস্ত আন্দোলনগুলোতে বামপন্থী দলগুলো, যারা মেহনতি ও অবদমিত মানুষদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরকে ঐ পিছিয়ে থাকা জাতিসত্তার ভেতরেই বিতর্ক এবং সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে আন্দোলনের গতিপথকে প্রভাবিত করার। আন্দোলনের ভিতরে সামিল বামপন্থী দলগুলোকে বাইরের বামপন্থী শক্তিগুলোর সমর্থনকে আদায় করারও চেষ্টা চালাতে হবে। এই লড়াই ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পর সমাজে অস্তিত্বশীল আরও নানা শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে ওঠা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে, এবং অবশ্যই জোরালো হয়ে উঠবে শ্রেণিসংগ্রাম।

এখন এই যে নিপীড়িত জাতির আন্দোলন, তাতে কীরকম নেতৃত্ব হলে তাকে সমর্থন করা যায়? এটা ঠিকই যে, আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে তাকে সমর্থন করা যায়। কিন্তু ঐ আন্দোলনের নেতৃত্ব কীরকম হবে, সেটা বাইরে থেকে ঠিক করে দেওয়াটা নিতান্তই অগণতান্ত্রিক— ওখানকার মানুষই সেটা ঠিক করবে, ঠিক করবে তাদের আন্দোলনের পথও। এটাও ঠিক নয় যে যতক্ষণ সেরকম কোন প্রগতিশীল নেতৃত্ব উঠে আসছে না, আমরা সেই লড়াইকে সমর্থন করবো না, অথচ দেখা যাচ্ছে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠছে। যেখানে প্রাথমিক কাজটা হল জাতিগত দমনপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা, সেখানে এরকম পূর্বশর্ত আরোপ করা মানে আন্দোলনের অগ্রগতিকে রুখে দেওয়া। এটা ঠিকই যে, আন্দোলনকে দমন করার জন্য এবং নিজের অর্থনৈতিক বা কৌশলগত স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো জাতিকে বিভক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা করে যাবে। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনের ভেতরের বামপন্থী শক্তিগুলোর দিক থেকে সতর্ক থাকা জরুরি— ইতিহাসে অসংখ্য শিক্ষা আছে এব্যাপারে এবং অবশ্যই তারই সাথে, বাইরের সংহতিমূলক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তাকে সাহায্য করতে হবে।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের কাজ হল সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের জন্য সর্বহারার এক আন্তর্জাতিক ঐক্য গড়ে তোলা। এটা দূরের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই কমিউনিস্টদের সমস্ত কাজ পরিচালিত হয়। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য অপরিহার্য শর্ত হল সমস্ত জাতির সমান অধিকারের জন্য সংগ্রাম। তার মানে দমনকারী জাতি যে যে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে, অবদমিত জাতি যতরকম গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়— সে সব কিছুরই উচ্ছেদ চাই। তাই মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের সমস্ত কাজেই এই সমান অধিকারের প্রশ্নটা প্রতিফলিত হবে— তার নীতিতে, জনগণকে সমাবেশিত করার প্রশ্নে এবং তার সংগঠনের আভ্যন্তরীণ চলার ধরনেও। লেনিন লিখছেন :

“আমরা গণতন্ত্রী বলে আমরা নির্দয়ভাবে কোনো জাতিসত্ত্বার ওপর যেকোনো শোষণ, তা যতটুকুই হোক না কেন, আমরা তার বিরুদ্ধে, এবং কোনো জাতিসত্ত্বাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ারও বিরুদ্ধে। গণতন্ত্রী হিসেবে, আমরা রাজনৈতিক অর্থে দাবী করি জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার… অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার। আমরা দাবী করি রাষ্ট্রের ভিতরে সমস্ত জাতির নিঃশর্ত সমানতা এবং প্রত্যেকটা জাতিগতভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য সুরক্ষিত গণতান্ত্রিক অধিকার। আমরা দাবী করি বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বৃহত্তর অর্থে নিজস্ব সরকার এবং নিজস্ব স্বশাসন, যে অঞ্চলগুলো নির্দিষ্টভাবে জাতিগতভাবে এবং অন্যান্য মানদন্ডের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত”। (লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ১৯, পৃঃ ১১৬)

এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থনের যারা বিরোধী, যারা সংশয়ী, তাদের জন্য একটা তুলনা তিনি রেখেছেন, যা আগে বহু ব্যবহৃত হয়েছে; আরও একবার সেটা রাখা যাক—

“…যারা আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতাকে, অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে সমর্থন করে, তাদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগটা হল বিবাহবিচ্ছেদের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়ালকারীকে পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করার মতই মূর্খতা ও ভন্ডামী। বুর্জোয়া সমাজে যেমন বিবাহবিচ্ছেদের স্বাধীনতাকে বিরোধিতা করে তারাই, যারা সওয়াল করে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির পক্ষে, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বুর্জোয়া বিবাহব্যবস্থা, তেমনই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করাটা আধিপত্যকারী জাতির বিশেষ সুবিধাভোগ এবং প্রশাসনের পুলিশী পদ্ধতির সপক্ষে সওয়াল করা ছাড়া আর কিছুই নয়, যা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির একদম বিরোধী…

প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে জনগণ খুব ভালোভাবেই ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের মূল্য বোঝে এবং ব্যাপ্ত বাজার ও বড় রাষ্ট্রের সুবিধাগুলো জানে। অতএব, তারা তখনই বিচ্ছিন্ন হতে চাইবে যখন জাতিগত নিপীড়ন এবং জাতির মধ্যে রেষারেষি সংযুক্তভাবে থাকা জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে এবং তা প্রত্যেকটা অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বাধা দিচ্ছে”। (জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার)

সমস্ত জাতির ক্ষেত্রেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হল একটা মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানে কোথাও স্বজাতির মানুষরা যে সীমানার মধ্যে আছেন, সেই সীমানার মধ্যে তাদের নিয়ে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের অধিকার পর্যন্ত। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারও। এই কথাগুলো বলার জন্য এখন আর মার্কসবাদী সাহিত্যের দরকার পড়ে না। বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র অনুশীলন করতে গিয়ে, মৌলিক তাত্ত্বিক কাঠামো থেকে পিছু হটে যাওয়ার, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বর্ণিত জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে ধারনাগুলো থেকে ক্রমশ পিছু হটে যাওয়ার উদাহরণগুলো বিশ্বজনগণের কাছে, বিশ্বের নিপীড়িত জাতিসত্তাগুলোর কাছে কমিউনিস্টদের বিশ্বাসযোগ্যতারও অভাব ঘটিয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের দাবিসনদে গৃহীত হয়ে গেল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। ১৯৪১-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রপক্ষ আটলান্টিক চার্টারে সই করে গ্রহণ করল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। ১৯৪২-এর জানুয়ারিতে ২৬টি দেশ সই করল জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে, সেখানেও গৃহীত হল এই নীতি। ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাতিসংঘের চার্টারে সায় দেওয়ার মধ্যে দিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ঢুকে পড়ল আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির কাঠামোর মধ্যে। চ্যাপ্টার ১, আর্টিকেল ১, পার্ট ২ তে ঘোষণা করা হল যে এই জাতিসংঘের চার্টারের উদ্দেশ্য হল—

“জনগণের সমান অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতির প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে জাতিগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিকশিত করা, এবং সার্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠাকে শক্তিশালী করার জন্য অন্যান্য যথাযথ পদ্ধতি গ্রহণ করা”।

সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদ (ICCPR) এবং আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ (ICESCR) দুটোরই আর্টিকেল ১-এ বলা হল—

“সমস্ত মানুষেরই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান (স্ট্যাটাস) নির্ধারণ করতে পারে এবং অবাধে তাদের আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া চালাতে পারে”।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সার্বজনীন ঘোষণা-এর আর্টিকেল ১৫ তে বলা হল—

“প্রত্যেকেরই একটা জাতি পরিচয়ের অধিকার আছে এবং কাউকেই অকারণে জাতি পরিচয় থেকে বঞ্চিত করার বা জাতি পরিবর্তন থেকে বিরত করা যাবে না”।

এগুলো যদিও এটা চিহ্নিত করে দেয়নি যে কীভাবে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে তারা পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে, কীভাবে কার্যকরী হবে এগুলো। তবু এসবের মধ্যে দিয়েই, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতির আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ১৯৪৬ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের ৩৭ টি দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এখনো এভাবে স্বাধীন হয় নানা দেশ। কয়েক বছর আগের ইস্ট তিমোর বা এই তো সেদিন দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন দেশ গড়াটাকে আমরা ভুলিনি। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়েই এই লড়াই এক কঠিন লড়াই। আজকের পৃথিবীতে তার ওপর সন্ত্রাসবাদের, বিচ্ছিন্নতাবাদের জুজু দেখিয়ে আন্দোলনগুলোকে যেমন দমন করা চলছে, তেমনই হাজির করে দেওয়া হচ্ছে এই প্রশ্ন যে— কোনটা বেশি জরুরি— অটুট সীমানা না জাতিসত্তাগুলোর মুক্তি?

উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে, বর্তমান জাতিরাষ্ট্র ও নিপীড়িত জাতিসত্তাগুলোর অসংখ্য সংঘাতের ফলে এই আত্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিতর্ক জীবন্তভাবে চলতে থাকলো জাতিসংঘের ভিতরে। ১৯৭৬-এ আলজিয়ার্সে সাক্ষরিত হল ‘জনগণের অধিকার বিষয়ক সার্বজনীন ঘোষণা’ যাতে বলা হল,

“প্রত্যেকটা মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের একটা অপরিহার্য্য ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার আছে। সেটা অবাধে তার রাজনৈতিক অবস্থানকে নির্ধারিত করবে এবং সেটা কোনো বিদেশী হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে। প্রত্যেকটা মানুষের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা থেকে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিদেশী আধিপত্য থেকে, বা কোনো বর্ণবিদ্বেষী শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার অধিকার আছে। প্রত্যেকটা মানুষের অধিকার আছে গণতান্ত্রিক সরকার পাওয়ার, যে সরকার জাতি, লিঙ্গ, বিশ্বাস, বা বর্ণের ভিত্তিতে ফারাক না করে সমস্ত নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং যা মানবাধিকারের প্রতি কার্যকরী সম্মান দেবে এবং সকলের জন্য মৌলিক স্বাধীনতা দেবে”।

মার্কসবাদ তো এভাবে দেখেছিল যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জিত হবে অবদমিত জাতির ওপর সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বৈপ্লবিক উৎখাতের মধ্যে দিয়ে। তার জন্য প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদী পুলিশ-মিলিটারি শক্তির অপসারণ, ঐ জাতির অঞ্চলে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক বা সর্বহারা সরকারের প্রতিষ্ঠা, এবং সাম্রাজ্যবাদ ও তার অনুচরদের হাত থেকে উৎপাদনের উপকরণকে বাজেয়াপ্ত করার মধ্যে দিয়ে। এইসব শর্ত পূরণ হলে, মানুষ গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে তার সাথে অন্য জাতিগুলোর সম্পর্ক, অন্য জাতিগুলোর এই হিসেবের মধ্যে তার ভূতপূর্ব দমনকারী জাতিও থাকতে পারে।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ শেষপর্যন্ত সাম্যের ভিত্তিতে জাতিগুলির স্বেচ্ছাকৃত ঐক্যের পক্ষে দাঁড়ায়। কিন্তু এই ঐক্য অবশ্যই স্বতঃপ্রণোদিত হতে হবে। লেনিন লিখলেন যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবির মানে রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো করা নয়, বরং গণতান্ত্রিকভাবে তাদের সংযুক্তির ভিত্তি তৈরি করা।

“আমরা দাবী করি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, অর্থাৎ স্বাধীনতা, অর্থাৎ নিপীড়িত জাতির জন্য বিচ্ছিন্ন হওয়ার স্বাধীনতা, এই কারণে নয় যে আমরা আর্থিকভাবে দেশকে বিভক্ত করার স্বপ্ন দেখেছি বা ছোট রাজ্যই আদর্শ একথা বলছি, বরং বিপরীতে আমরা বড় রাষ্ট্র চাই, এবং চাই গভীর ঐক্য বা এমনকি রাষ্ট্রগুলোর সংযুক্তি, কিন্তু তা কেবলমাত্র সত্যিকারের গণতন্ত্রের, সত্যিকারের আন্তর্জাতিকতার ভিত্তিতে, যা বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার দেওয়া ব্যতিরেকে অর্জন করাই সম্ভব নয়”। (লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ২১, পৃঃ ৪১৩-১৪)

জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইকে কখন কেন সমর্থন?

অতএব মার্কসবাদীদের দিক থেকে এই লড়াইকে সমর্থন করতে গিয়ে এমন হবে না, যে যেকোনো অবস্থায়, যে কোন শর্তে সমর্থন করতে হবে। মার্কসবাদীরা বিচার করবে যে কোন জাতির লড়াই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দুর্বল করছে কিনা, সর্বহারা ঐক্যকে মজবুত করছে কিনা। প্রথম দিকে সংশয় থাকলেও পরে মার্কস অনেকগুলি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন। জার্মানি ও ইতালির ঐক্য, পোল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের জাতীয় স্বাধীনতা সেই দেশগুলোতে শ্রমিকদের নিজস্ব সংগ্রাম বিকাশের পক্ষে সহায়ক বাতাবরণ তৈরির ইঙ্গিত করছিল। তারই সাথে এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সাথে সংহতি জ্ঞাপনকে তিনি দমনকারী জাতির সর্বহারাদের আন্তর্জাতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার একটা জরুরী উপাদান হিসেবে তিনি দেখেছিলেন। আবার অন্যত্র তিনি চেক ও দক্ষিণ স্লাভদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে বিরোধিতা করেছেন, কারণ সেগুলো সমর্থন করলে ইউরোপের বিপ্লবী আন্দোলনের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক রাশিয়ার জারতন্ত্রকে মদত দেওয়া হত।

“আমরা যখন নিপীড়িত জনগণের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে, তাদের রাজনৈতিক ভবিতব্যকে নিজেরাই নির্ধারণের অধিকারকে স্বীকৃতি দিই, তখন তা দিয়ে কোনো কোনো নির্দিষ্ট জাতি রুশ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হবে সেই প্রশ্নটাকে ঠিক করে দিই না। মানুষের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু সে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সেই অধিকার অনুশীলন করবে বা করবে না। তার মানে আমরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে আওয়াজ ওঠাবো না বিপক্ষে, সে প্রশ্নে আমরা স্বাধীন, আমরা তা করবো সর্বহারার, সর্বহারা বিপ্লবের স্বার্থ অনুযায়ী। অতঃপর, বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের প্রশ্নটা প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রভাবে ঠিক করতে হবে, প্রদত্ত পরিস্থিতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ভাবে তা করতে হবে, এবং সেই কারণে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতির প্রশ্নটা কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বাস্তবতা আছে কি নেই তার সাথে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।” (স্তালিন রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ৩, পৃঃ ৫৫)]

এটা নিয়ে মার্কসবাদীরা যদি মনে করে যে কোন আন্দোলন প্রলেতারীয় দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে ক্ষতিকারক হচ্ছে, তাহলে সে নিশ্চয়ই প্রচার করতে পারে, অবদমিত জাতির মানুষের কাছে, তার শ্রমজীবী অংশের কাছে যুক্তিগুলোকে হাজির করতে পারে, সাম্রাজ্যবাদের সেখানে ভূমিকাকে বিরোধিতা করতে পারে, এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সমস্ত প্রক্রিয়া নিতে পারে, কিন্তু জোর করে তার বক্তব্যকে চাপিয়ে দিতে পারে না। তাহলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মূল কথাটাকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়। ধর্ম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্তালিন যেভাবে বলেছেন, এখানেও তাই— নিপীড়িত জাতিসত্তার যদি দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা থাকে, তাহলেও এভাবেই দেখতে হবে কম্যুনিস্টদের —

“সমাজ গণতন্ত্রীরা সবসময়ই ক্যাথলিকবাদ বা প্রটেস্টান্টবাদের করা হয়রানির প্রতিবাদ করবে; তারা সবসময়ই জাতিসত্ত্বাগুলোর নিজের পছন্দ অনুযায়ী ধর্মাচরণের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবে; কিন্তু একই সাথে সর্বহারার স্বার্থ সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, তারা ক্যাথলিকবাদ, প্রটেস্টান্টবাদ ও রক্ষনশীল চার্চের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার চালাবে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্ববীক্ষার বিজয়ের লক্ষ্যে।”(স্তালিন রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ৩, পৃঃ ৩৬৮-৬৯)

জাতিরাষ্ট্র ও স্বশাসন

মার্কসবাদী ধারনায় জাতিরাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি এসেছে আঞ্চলিক স্বশাসনের কথাও। লেনিনের কথায়—

“…এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কেন, সমাজ-গণতন্ত্রী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের’ অধিকার মানে ফেডারেশনও (সার্বভৌম) নয়, স্বশাসনও নয় (যদিও সারসংক্ষেপে বলতে গেলে দুটোই ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের’ আওতাতেই আসবে) …স্বশাসনের কথা যদি আসে, তাহলে বলতে হয় মার্কসবাদীরা, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাধারণ সার্বজনীন নীতি হিসেবে, যে রাষ্ট্রে জাতিগত মিশ্রণ আছে, এবং ভৌগোলিক ও অন্যান্য পরিস্থিতির বিশাল বৈচিত্র্য আছে, সেখানে স্বশাসনের অধিকার নয়, বরং খোদ স্বশাসনের পক্ষে দাঁড়ায়।” (লেনিন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং জাতিসমূহের অধিকার)

এখন এই স্বশাসনের মাত্রা কী হবে, কী থাকবে তার অধিকারে এর কোন সুনির্দিষ্ট ছক নেই। স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্বশাসন প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে বললেন,

“সোভিয়েত স্বশাসন কোনো জড়বস্তু নয় যে একবার ঠিক হলে আর বদলাবে না; এটা উন্নয়নের সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও মাত্রাগত রূপগুলোকে অনুমোদন দেয়। এটা সংকীর্ণ প্রশাসনিক স্বশাসন থেকে শুরু করে একটা প্রশস্ত রাজনৈতিক স্বশাসনের দিকে এগোতে থাকে, … প্রশস্ত রাজনৈতিক স্বশাসনের থেকে আরো প্রশস্ত … রূপের দিকে এগোয়; এবং ক্রমশ একটা সমঝোতার সম্পর্কের দিকে যায়।” (স্তালিন রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ৪, পৃঃ ৩৬৭)

এখানে স্বশাসন বলতে যা বোঝানো হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতটা বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়া হলেও, আমরা মার্কসবাদী-লেনিনবাদিদের অবস্থানের স্বচ্ছতার প্রশ্নকে মাথায় রেখে সেটাকে আলোচনায় আনতে পারি।

স্বশাসন বলতে এখানে যা সংজ্ঞায়িত হয়েছে তা একজন মামুলি স্বশাসিত পর্ষদও বোঝাতে পারে, একটা রাজ্যও বোঝাতে পারে। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মত দেশে যেখানে আইনি কাঠামোটা এমনই যে বেশিরভাগ ক্ষমতাই কেন্দ্রের হাতে সীমাবদ্ধ, রাজ্যের হাতে সীমিত ক্ষমতা— সেখানে আলাদা রাজ্যের মানেও এই সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বশাসন বলতে যা বোঝানো হয়েছে, সেরকমই একটা কিছু হবে। আর একটা কথাও খেয়াল রাখার দরকার যে স্বশাসন মানে কিন্তু বিচ্ছিন্নতা নয়। এখন স্বশাসন ব্যাপারটা সাধারণতঃ কোথায় প্রযোজ্য হবে? ধরে নেওয়া হয়েছে যে পিছিয়ে থাকা জনজাতির ক্ষেত্রে, বিভিন্ন জনজাতির মিশ্রণ যেখানে আছে, জাতির সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলো যাদের মধ্যে নেই, সেখানে এটা প্রযোজ্য হবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে তো সেই জনজাতিরও বিকাশ হবে, তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষারও মাত্রা বাড়তে থাকবে।

আন্দোলনের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিপদ

সেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করার জন্য বুর্জোয়াদের হাতিয়ার হল জাতীয়তাবাদের স্লোগান। কখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, কখনো তেলেগু জাতীয়তাবাদ আর সবসময়ই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মত শব্দগুলো আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তো এর বিপরীতে আন্তর্জাতিকতার কথা বলে— সর্বহারার আন্তর্জাতিক ঐক্য— যা জাতীয়তাবাদের ঠিক বিপরীত। জাতীয়তাবাদটা যারই হোক, দমনকারী বা অবদমিত, যে কোন জাতিরই হোক না কেন, সেটা একটা বুর্জোয়া দর্শন। এটার ভিত্তি হল ‘জাতীয় ঐক্য’— অন্য সমস্ত জাতির বিরুদ্ধে সেই জাতির সর্বহারা ও বুর্জোয়ার ঐক্য। বিপ্লবী সর্বহারা শ্রমজীবী জনতাকে তাঁদের জাতির বুর্জোয়াদের থেকে আলাদা করতে চায়, জাতীয়তাবাদের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করতে চায়, এবং তাদেরকে সারা দুনিয়ার সর্বহারাদের শ্রেণিসংগ্রামের সাথে একসুরে বাঁধতে চায়। লেনিন লিখলেন :

“পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণি ও তার সংগ্রামের চাহিদা হল সমস্ত জাতির শ্রমিকদের সম্পূর্ণ সংহতি ও ঘনিষ্ঠতম ঐক্য; তারা চায় সমস্ত জাতির বুর্জোয়াদের দিক থেকে নেওয়া জাতিগত নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। সুতরাং সমাজ-গণতন্ত্রীরা সর্বহারার নীতি থেকে বিচ্যুত হবে যদি তারা জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্থাৎ নিপীড়িত জাতির বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের ধারণাকে বাতিল করে, অথবা তারা যদি নিপীড়িত জাতির বুর্জোয়াদের সমস্ত জাতিগত দাবী সমর্থন করে। একজন মজুরি শ্রমিক মূলতঃ বৃহৎ রুশ বুর্জোয়া দ্বারা শোষিত হচ্ছে না অ-রুশ বুর্জোয়া দ্বারা, অথবা পোলিশ বুর্জোয়া নাকি ইহুদি বুর্জোয়া বা অন্য কোনো— তাতে তার কোনো ফারাক পড়ে না। … যে মজুরি শ্রমিকটি তার শ্রেণি স্বার্থ বুঝেছে, সে বৃহৎ রুশ পুঁজিপতিদের রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা বা পোলিশ অথবা ইউক্রেনীয় পুঁজিপতির রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেলে পৃথিবীর বুকে স্বর্গ রচনার আশ্বাসের ব্যাপারে সমান উদাসীন থাকে। পুঁজিবাদ বিকশিত হচ্ছে এবং তা বিকশিত হতে থাকবে, যেভাবেই হোক না কেন, সে রাষ্ট্র জাতিগত সংমিশ্রণের হোক বা পৃথক স্বতন্ত্র জাতির হোক। …

যে কোনো ক্ষেত্রেই মজুরি শ্রমিকটি শোষণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে। শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সফল হতে গেলে সর্বহারাকে জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্ত হতে হবে, বলা যায় পুরোপুরি নিরপেক্ষ হতে হবে বিভিন্ন জাতির বুর্জোয়াদের মধ্যে চলা শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই সম্পর্কে। কোনো জাতির সর্বহারা যদি তাদের ‘নিজেদের’ জাতীয় বুর্জোয়ার প্রতি সামান্যতম সমর্থনও দেখায়, তাহলে তা অন্য জাতির সর্বহারার মধ্যে অবধারিতভাবে অবিশ্বাসের জন্ম দেবে; তা বুর্জোয়াদের পক্ষে স্বস্তিদায়কভাবে শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক শ্রেণি সংহতিকে দুর্বল করবে, বিভক্ত করবে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অথবা বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করার মানে হল, অবশ্যম্ভাবীভাবে, বাস্তবত প্রাধান্যকারী জাতির বিশেষ সুবিধাভোগকে সমর্থন করা।” (জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার)

দুই জাতীয়তাবাদ

কম্যুনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে বারবারই জাতি-প্রশ্নে দুটি বিপরীতমুখী ভ্রান্তি এসে হাজির হয়েছে। প্রথমটা উৎপীড়ক জাতির জাতীয়তাবাদ। কম্যুনিস্ট আন্দোলনের শক্তির মধ্যে যারা উৎপীড়ক জাতির শ্যভিনিজমে (জাতীয়তাবাদে) আক্রান্ত, তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষা থেকে শুধুমাত্র জাতিগুলোর স্বেচ্ছাকৃত ঐক্যের প্রশ্নটা আওড়ে যায়। স্বেচ্ছাকৃত ঐক্যের মানেটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সাম্রাজ্যবাদের বেঁধে দেওয়া ঐক্যের বিরুদ্ধে তারা কথা বলে না, সমানাধিকারের কথা বলেও বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে স্বীকার করে না তারা — তাতে নাকি শ্রমিকশ্রেণি ‘ভাগ’ হয়ে যাবে। তারা বুঝতেই পারে না যে, যতক্ষণ জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অবদমিত থাকবে, উৎপীড়ক ও উৎপীড়িত জাতির শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে প্রকৃত ঐক্য স্থাপিতই হবে না। লেনিন লিখলেন :

“উত্পীড়ক জাতির সর্বহারাদের দিক থেকে, শান্তিকামী বুর্জোয়ারা বারংবার যে কথাগুলো বলে থাকে সেই সংযুক্তিকরণের বিরুদ্ধে এবং জাতিগত সমানতার সপক্ষে গতে বাঁধা বুলির মধ্যে নিজেদের আটকে রাখা উচিত নয়। একটা রাষ্ট্রের সীমানার প্রশ্ন, যা প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে জাতিগত শোষণের ওপর এবং যে প্রশ্নটা সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের পক্ষে নিতান্তই ‘অপ্রিয়’, সে বিষয়ে সর্বহারা শ্রেণি নিশ্চুপ থাকতে পারে না। প্রদত্ত রাষ্ট্রের সীমানার ভিতরে নিপীড়িত জাতিগুলোকে বলপূর্বক ধরে রাখার বিরুদ্ধে সর্বহারাদের লড়াই করতে হবে যার মানে তাদের লড়তে হবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য। সর্বহারাদের ‘তাদের নিজেদের’ জাতির দ্বারা অবদমিত উপনিবেশ ও জাতিসমূহের রাজনৈতিকভাবে আলাদা হওয়ার স্বাধীনতার দাবী করতে হবে। অন্যথায়, সর্বহারার আন্তর্জাতিকতা নিয়ে কথাগুলো ফাঁকা বুলিতে পর্যবসিত হবে; নিপীড়িত ও নিপীড়ক জাতির সর্বহারাদের মধ্যে না তৈরী হবে ভরসা, না সম্ভব হবে শ্রেণিসংহতি; এবং সংস্কারপন্থী ও কাউটস্কিপন্থীরা, যারা আত্মনিয়ন্ত্রণের সপক্ষে কথা বলে কিন্তু ‘তাদের নিজেদের’ জাতির দ্বারা অন্য জাতিসমূহের অবদমন ও ‘তাদের নিজেদের’ রাষ্ট্রে জোর করে ধরে রাখার ব্যাপারে নীরব থাকে, তাদের দ্বিচারিতাও স্পষ্ট হবে না।” (লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ২২, পৃঃ ১৪৭)

রাশিয়ার নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন নিজে বড় জাতির প্রতিনিধি হয়ে লিখছেন নিজের পক্ষে অনুভূত সমস্যার গভীরতাকে—

“জাতিপ্রশ্নে আমার লেখাগুলোতে আমি আগেই বলেছি যে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে একটা আবছা উপস্থাপনা সাধারণভাবে আদৌ কোনো কাজের নয়। দমনকারী জাতির ও অবদমিত জাতির জাতীয়তাবাদের মধ্যে, বড় জাতি ও ছোট জাতির জাতীয়তাবাদের মধ্যে অবশ্যই একটা পার্থক্য করতে হবে।

দ্বিতীয় ধরণের জাতীয়তাবাদের প্রশ্নের সাপেক্ষে আমরা, বড় জাতির মানুষরা, ইতিহাসের ধারায় প্রায়শই অগুনতি হিংসার ঘটনার জন্য দোষী থেকেছি; তার ওপর অসংখ্যবার ঠিকমত ঠাহর না করেই আমরা হিংসা ও অপমানের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলি। আমার ভলগার স্মৃতিগুলো মনে করাটাই যথেষ্ট যে কিভাবে অ-রুশীয়দের সাথে ব্যবহার করা হয়েছিল; কিভাবে পোল্যান্ডবাসীদের পোলিয়াচিস্কা ছাড়া আর কোন নামে ডাকা হয় না, কিভাবে তাতারদের রাজপুত্র বলে ডাকা হয়, কিভাবে ইউক্রেনীয়দের সবসময় খোখল, আর জর্জিয়ান এবং অন্য ককেশিয়ানরা সবসময় কাপকাশিয়ান বলে ডাকা হয়।

সেই কারণেই দমনকারী বা তথাকথিত ‘বড়’ জাতির (তারা বড় শুধু হিংসাশ্রয়ের প্রশ্নে, অপদস্থ করার প্রশ্নে) পক্ষে আন্তর্জাতিকতা শুধু জাতিসমূহের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সমানতার অনুশীলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, বরং দমনকারী জাতির, বড় জাতির দিক থেকে একটা অসমানতাও অনুশীলন করতে হবে, যা বাস্তবে চলা অসমানতার পরিপূরণ করবে। যে এই ব্যাপারটা বোঝে না, সে জাতিপ্রশ্নে সঠিক সর্বহারা অবস্থানকে আত্মস্থ করতে পারেনি, সে আসলে তার দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পেটিবুর্জোয়া অবস্থানে রয়ে গেছ, এবং তার ফলে, অবশ্যম্ভাবীভাবে বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঢলে পড়বে।” (জাতিসমূহ বা ‘স্বশাসিতকরণের’ প্রশ্ন)

মার্কস ও এঙ্গেলস আইরিশদের প্রশ্নে আলোচনা করতে গিয়ে জাতিসত্তা আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গে নিপীড়ক জাতির শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে কী গভীর রাজনৈতিক ক্ষয়ের জন্ম হয়, সেকথা আলোচনা করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে। বহু শতাব্দী ধরে আয়ারল্যান্ড ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল, ১৮০১ সাল থেকে যারা বাধ্য হল বলপূর্বকভাবে ইংল্যান্ডের সাথে এক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঢুকতে। মার্কস প্রথমে ভেবেছিলেন যে আয়ারল্যান্ডের মুক্তি অবদমিত আইরিশ জনগণের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে হবে না, বরং তা সম্পন্ন হবে ইংরেজ শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ইংল্যান্ডের শ্রমিক আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে বুর্জোয়া উদারনীতিবাদীদের প্রভাবে থাকার ফলে রাজনৈতিকভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ইংরেজ শাসকদের দিক থেকে আয়ারল্যান্ডে নির্বিচার লুণ্ঠনের ফলে আয়ারল্যান্ডে বুর্জোয়া জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম জন্ম নিয়েছে এবং যা এক বৈপ্লবিক গতি পেয়েছে। ১৮৬৭ তে এঙ্গেলসকে লেখা এক চিঠিতে মার্কস ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে আয়ারল্যান্ডের উপনিবেশীকরণ ইংরেজ শ্রমিকদের শ্রেণিচেতনার বিকাশকে থমকে দিয়েছে—

“আমি ইংল্যান্ড থেকে আয়ারল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাকে অসম্ভব বলে ভাবতাম…কিন্তু এখন আমার মনে হয় এটা অবশ্যম্ভাবী, যদিও বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ফেডারেশন গঠিত হতে পারে। …

…ইংল্যান্ডের সমস্ত শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো এখন শ্রমিকশ্রেণির দুটো বৈরিতাপূর্ণ শিবিরে বিভক্ত: ইংরেজ সর্বহারা ও আইরিশ সর্বহারা। একজন সাধারণ ইংরেজ শ্রমিক আইরিশ সর্বহারাদের ঘৃণা করে কারণ সে ঐ আইরিশ শ্রমিকের মধ্যে একজন প্রতিযোগীকে দেখতে পায় যে তার জীবনযাত্রার মানের অবনমন ঘটাচ্ছে। আইরিশ শ্রমিকের সাপেক্ষে সে নিজেকে শাসক জাতির সদস্য মনে করে এবং সেই কারণেই সে নিজেকে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিজাত ও পুঁজিপতিদের একটা যন্ত্রে পরিণত করে এবং তার ফলে নিজের ওপরেই তাদের আধিপত্যকে শক্তিশালী করে…

(অতঃপর) … ইংরেজ শ্রমিকশ্রেণির প্রত্যক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ স্বার্থেই তাদের আয়ারল্যান্ডের সাথে বর্তমান সম্পর্ক থেকে মুক্ত হতে হবে। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করেছি যে, ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণির জাগরণের পথেই আইরিশ রাজত্বের অবসান ঘটবে। কিন্তু এখন গভীর নিরীক্ষণের মধ্যে দিয়ে আমি বুঝেছি যে ব্যাপারটা এর বিপরীত। ইংরেজ শ্রমিকশ্রেণি কখনোই কিছু অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না আয়ারল্যান্ডের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে।”

অগ্রণী জাতির জাতীয়তাবাদের সমস্যায় যারা আক্রান্ত তারা আজকের দেশের বা রাজ্যের সীমানাগুলোকে চিরন্তন বলে ভাবে। রাজনৈতিকভাবে ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার অধিকারকে তারা অসম্ভব মনে করে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার তো যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো সময় স্বীকার করা উচিত, তার বাস্তবতা আছে কি নেই সেটা এখানে প্রশ্নই নয়। যা আজ অসম্ভব, তা অচিরেই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

“১৯১২ সালে যখন আমরা রুশীয় মার্কসবাদীরা, জাতিপ্রশ্নে প্রথম খসড়া তৈরী করছিলাম, তখন রুশ সাম্রাজ্যের কোনো সীমানাতেই স্বাধীনতার দাবিতে কোনো গুরুত্বপুর্ণ আন্দোলন চলছিলো না। তাসত্ত্বেও, জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্থাৎ প্রতিটি জাতির বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্বে থাকার অধিকারের বিষয়টিকে আমরা আমাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করাটাকে প্রয়োজনীয় মনে করেছিলাম, কেন? কারণ আমরা যা আছে শুধু তার ওপর নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে সাধারণভাবে যা বিকশিত হচ্ছে এবং যা আসন্ন, তার ওপর দাঁড়িয়েছিলাম, অর্থাৎ, আমরা শুধু বর্তমানকেই হিসেবের মধ্যে নিই নি, ভবিষ্যতকেও ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েছিলাম। আমরা জানতাম যে যদি কোন জাতি আলাদা হওয়ার দাবী তোলে, তাহলে রুশীয় মার্কসবাদীদের দিক থেকে এরকম সমস্ত জাতির বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারকে সুনিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।” (স্তালিন রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ৭, পৃঃ ৭২-৭৩)

একই প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে লেনিন লিখছেন—

“যদি ইউক্রেনের উদাহরণ নিই যে তারা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে, কিন্তু হাজারটা অনির্ণেয় বিষয় দ্বারা সেটা নির্ণীত হবে। আমাদের সেক্ষেত্রে নিরর্থক ‘অনুমানের’ চেষ্টা না করে, জোরালোভাবে যা সন্দেহের ঊর্ধ্বে, সেই কথাটাকে তুলে ধরতে হবে: এরকম একটা রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে ইউক্রেনের অধিকারের কথা…

বুর্জোয়া বিপ্লবগুলোর পর্যায়ে সমস্ত জাতিগুলোর যে উল্লম্ফন, তাতে তাদের জাতিরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে নানা সংঘর্ষ এবং সংগ্রাম বাস্তবত ও আবশ্যকভাবে করতে হয়েছে। আমরা সর্বহারারা আগেভাগেই ঘোষণা করি যে আমরা বৃহৎ রুশীয়দের বাড়তি সুযোগসুবিধার বিরুদ্ধে, এবং এটাই আমাদের সমস্ত প্রচার ও আন্দোলনের নির্দেশিক হিসেবে রয়েছে।

‘বাস্তবতার’ খোঁজ করতে গিয়ে রোজা লুক্সেমবার্গ বৃহৎ রুশীয় সর্বহারার এবং অন্যান্য জাতির সর্বহারাদের মুখ্য বাস্তব কাজকে দেখতে পাননি: সেটা হল, সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও জাতিগত সুযোগসুবিধা দানের বিরুদ্ধে এবং সমস্ত জাতির তাদের জাতিরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে অধিকার, সমান অধিকারের পক্ষে প্রতিদিনকার আন্দোলন ও প্রচারের কাজ।” (লেনিন সংগৃহিত রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ২০, পৃঃ ৪১৪-১৫)

এতো গেল প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যাটা হল নিপীড়িত জাতির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের কবলে পড়া। এখানে সমস্যাটা উল্টো। তারা শুধু নিজেদের জাতির মুক্তির প্রশ্নটাকে বোঝে, কিন্তু এই লড়াইয়ের দূরের লক্ষ্য যে জাতিগুলির স্বেচ্ছাকৃত একীকরণ— সেটা বুঝতে চায় না। তাহলে কী করে সম্ভব হবে আন্তর্জাতিকভাবে সর্বহারার ঐক্য আর কিভাবেই বা সম্ভব হবে সমাজতন্ত্র? তারা শুধু দেখতে পায় যা তাদের জাতির বুর্জোয়ারা দেখে— তাদের জাতির মুক্তি। এবং প্রায়শই সঠিক দিশায় না থাকতে পারায় বেলাইন হয় সেই লড়াই, ক্ষতিগ্রস্ত করে শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যকে। সুতরাং এই জাতিসত্তার লড়াইয়ে সামিল হয়ে কম্যুনিস্টদের অভিমুখ কী হবে? নিপীড়িত জাতির বুর্জোয়াদের সাথে তাদের সম্পর্ক কী হবে?

“জাতিপ্রশ্নে (অন্যান্য প্রশ্নের মতই) সর্বহারার নীতি হল একটা নির্দিষ্ট দিশায় বুর্জোয়াদের সমর্থন করা, কিন্তু তা কখনোই বুর্জোয়াদের নীতির সাথে এক হয়ে যায় না। শ্রমিকশ্রেণি বুর্জোয়াদের সমর্থন করে শুধুমাত্র জাতিগত শান্তি রক্ষা করার জন্য (যেটা পুরোপুরিভাবে বুর্জোয়ারা আনতে পারে না, এবং যা শুধুমাত্র পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র দ্বারাই অর্জন করা সম্ভব), সমান অধিকার অর্জন করার জন্য এবং শ্রেণি সংগ্রামের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য। …জাতিপ্রশ্নে সমস্ত বুর্জোয়ারাই যেটা করে সেটা হল, হয় তার নিজের জাতির জন্য বিশেষ পক্ষপাত, বা ব্যতিক্রমী ধরণের সুযোগসুবিধা… সর্বহারা এরকম সমস্ত পক্ষপাতের, সমস্ত বিশেষাধিকারের বিরোধী…

…বুর্জোয়ারা সবসময়ই তাদের জাতিগত দাবীদাওয়াকে সামনে রাখে, এবং তা করে একটা সুবিন্যস্ত কায়দায়। কিন্তু সর্বহারার ক্ষেত্রে, মোটের ওপর, এই দাবিগুলো শ্রেণিসংগ্রামের স্বার্থের অধীনে থাকে। …

…নিপীড়িত জাতির সমাজতন্ত্রীদের দিক থেকে, বিশেষতঃ, নিপীড়িত জাতির শ্রমিক ও দমনকারী জাতির শ্রমিকদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ও নিঃশর্ত ঐক্যের, এমনকি সাংগঠনিক ঐক্যের সপক্ষে দাঁড়াতে এবং কার্যকরী করতে হবে। এটা না করে বুর্জোয়াদের দিক থেকে চলা সমস্ত ধরণের চক্রান্ত, বিশ্বাসঘাতকতা ও শঠতার সামনে দাঁড়িয়ে সর্বহারার স্বাধীন নীতি ও তাদের সাথে অন্য দেশের সর্বহারার শ্রেণি সংহতির সপক্ষে দাঁড়ানো অসম্ভব।” (লেনিন সংগৃহীত রচনাবলী, ইংরাজী, খন্ড ২০, পৃঃ ৪০৯-১২)

নিপীড়ক ও নিপীড়িত দুই জাতির মধ্যের এই দু’ধরনের জাতীয়তাবাদের সমস্যাই হল আন্দোলনের মধ্যে, কম্যুনিস্ট চিন্তার বৃত্তের মধ্যে বুর্জোয়াদের, বুর্জোয়া চিন্তার আধিপত্য। নিপীড়ক জাতির কম্যুনিস্টদের ভাবনায় বুর্জোয়া প্রভাবটা বেশি মারাত্মক কারণ তার পিছনে থাকে বড় জাতির বুর্জোয়াদের, ক্ষমতায় থাকা বুর্জোয়াদের প্রভাব। তার সাথে জুড়ে থাকে নিপীড়ক জাতির মেহনতি মানুষের যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা আধিপত্যের চিন্তা। তাই এখানে বাড়তি সতর্কতা থাকতে হবে।

“আর কোনকিছুই জাতিগত অন্যায়ের মত করে সর্বহারা শ্রেণিসংহতির বিকাশ ও দৃঢ়ীকরণকে থমকে দিতে পারে না; ‘বিরূপ’ জাতির মানুষরা সমানতা বা সেই সমানতা ভঙ্গের ব্যাপারে, যতটা স্পর্শকাতর হয় ততটা আর কোনকিছুতেই হয় না, যদি তাদের সর্বহারা কমরেডদের দিক থেকে অবজ্ঞা বা আত্মম্ভরিতার কারণে সেই সমানতা বিঘ্নিত হয়। সেই কারণে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে ছাড় ও সহনশীলতা বেশি বৈ কম হওয়া উচিত নয়। সেই কারণে, এক্ষেত্রে, সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রামের মৌলিক স্বার্থের দিক থেকে জাতি প্রশ্নে কোন আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত নয়, বরং সবসময়ই দমনকারী (বা বড়) জাতির প্রতি নিপীড়িত (বা ছোট) জাতির সর্বহারাদের নির্দিষ্ট মনোভাবকে হিসেবে নিতে হবে।”

“কোনো জাতি কি মুক্ত হতে পারে যদি সে অন্য জাতিদের দমন করে? না পারেনা… বৃহৎ রুশীয় সর্বহারা তার নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না বা তার নিজের স্বাধীনতার রাস্তা উন্মুক্ত করতে পারবে না যদি না সে এই সংস্কারগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করে… আমরা একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের মাটিতে লড়াই করছি; আমরা এই রাষ্ট্রে বসবাসকারী সমস্ত জাতির শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করছি, আমরা কিন্তু কোন নির্দিষ্ট রাস্তায় জাতীয় উন্নতির কথা বলতে পারি না, কেননা আমরা আমাদের শ্রেণির লক্ষ্যের দিকে সমস্ত সম্ভাব্য পথ ধরে এগোচ্ছি… আমরা সেই লক্ষ্যের দিকে এগোতে পারবো না যতক্ষণ না আমরা সমস্ত জাতীয়তাবাদকে পরাস্ত করছি, এবং সমস্ত জাতির সমানতার প্রশ্নটাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছি।” (লেনিন, জাতিসমূহ বা ‘স্বশাসিতকরণের’ প্রশ্ন)

মার্কসবাদীরা শেষতঃ সমস্ত ধরণের জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে কারণ তা একটা পুঁজিবাদী মতাদর্শ। পুঁজিবাদীরা শ্রমিকশ্রেণি সহ গরিব জনতার কাছে তাদের ‘অংশের স্বার্থকে’ সরিয়ে রেখে জাতির (রাষ্ট্রের) ভালোর জন্য অংশগ্রহণ করতে বলে। তার উত্তরে, মার্কসবাদীরা শ্রমিকশ্রেণির সওয়াল করে আন্তর্জাতিকতার পক্ষে — পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সমস্ত জাতির শ্রমিকদের ঐক্য ও সংহতির কথা বলে। কিন্তু সমস্ত জাতির বুর্জোয়াদের জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা দেখি যে নিপীড়িত জাতির জাতীয়তাবাদের মধ্যে একটা সাধারণ গণতান্ত্রিক সারবস্তু আছে কেননা তা তৈরি হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী বা বড় পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে। তাই জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে এই লড়াইকে আমরা সমর্থন করি।

সাম্রাজ্যবাদের অগ্রগতির সাথে সাথে, নিপীড়িত জাতির প্রকৃত জাতীয় মুক্তি তখনই জেতা সম্ভব যখন শ্রমিকশ্রেণি সহ মেহনতি জনগণের অধিকারের প্রশ্নকে জয়লাভ করানোর মধ্যে দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণীবাহিনী পুঁজিপতিদের হাত থেকে জনগণের নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিতে পারবে। এই নেতৃত্ব অর্জন করতে গেলে তাদেরকে সংগঠিত করতে হবে বুর্জোয়াদের প্রভাবের বাইরে। ১৯২০ তে কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসের ‘জাতীয় ও উপনিবেশ প্রশ্নে পরিপূরক দলিলসমূহ’তে এবিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশ ছিল এবং ১৯২২-এর চতুর্থ কংগ্রেসে গৃহীত ‘প্রাচ্য প্রশ্নে দলিলসমূহ’তে তা আরও স্পষ্টভাবে আসে —

“উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, স্বতন্ত্র শ্রেণিস্বার্থের ‘যুক্তি’র পরিপ্রেক্ষিতে, কমিউনিস্টদের দিক থেকে সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নারাজ হওয়াটা একেবারে নিকৃষ্ট ধরণের সুবিধাবাদ এবং তা শুধু প্রাচ্যে সর্বহারা বিপ্লবকে নিন্দিতই করবে … উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশের কম্যুনিস্ট ও সর্বহারার দলগুলো যুগপত্ভাবে দুটো কর্তব্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে : একদিকে, তারা জাতীয় রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিশায় পরিচালিত বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দাবিগুলোকে জেতার প্রশ্নে আরো বৈপ্লবিক একটা উত্তর পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে; অন্যদিকে, তারা জাতীয় বুর্জোয়া শিবিরের দ্বন্দ্বগুলোকে ঠিকমত কাজে লাগিয়ে নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে সংগ্রাম করার জন্য শ্রমিক ও কৃষক জনতাকে সংগঠিত করছে।”

জাতি প্রশ্ন এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক?

বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রণ এখন পৃথিবীর বড় বড় কয়েকশো কোম্পানির হাতে। পুঁজির কেন্দ্রীভবনের মাত্রা আকাশ ছুঁয়েছে। প্রতিদিন চলছে লক্ষ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, যার অধিকাংশই সংঘটিত হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে। একচেটিয়া পুঁজির গ্রাস ক্রমবর্ধমান, বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয়িত হচ্ছে তার জন্য, আর ক্ষমতা অকল্পনীয় মাত্রায় কুক্ষিগত হচ্ছে হাতেগোনা কোম্পানিগুলোর হাতে। আরও আরও মুনাফার লোভে হিংস্রভাবে দৌড়ে বেড়াচ্ছে তারা। এই জয়যাত্রায় বিজিত পক্ষে দাঁড়িয়ে অগণিত শ্রমিকশ্রেণি। কোম্পানিগুলোর প্রত্যেকটা সংযুক্তির খবর বয়ে নিয়ে আসছে অনেক ছাঁটাই, ক্লোজার আর চাপিয়ে দিচ্ছে বাড়তি কাজের বোঝা।

‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ বইতে লেনিন বলেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদ হল বড় একচেটিয়া ও ট্রাস্টের যুগের পুঁজিবাদ। কিন্তু আজকের একচেটিয়াকরণের মাত্রা লেনিনের সময়ের থেকেও দৈত্যাকার চেহারা নিয়েছে। এ বিষয়ে চর্চার বিশদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই এখানে, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রোগভোগের সমস্যার কোনও সমাধান তবু হচ্ছে না, আর কর্পোরেটরা ক্রমশঃ একাকার হয়ে যাচ্ছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আর তার দমনযন্ত্রের সাথে। এখানে একটা দ্বন্দ্ব এসে হাজির হচ্ছে। বিশ্বায়নের লাগামহীন দৌড়ের পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের একাংশের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য হাজির করা হচ্ছে যে, জাতিরাষ্ট্র আর আজকের দিনে কোনও গুরুত্বের বিষয় নয়। এই কথাটা কোন নতুন কথা নয়। এই যুক্তিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাউটস্কি হাজির করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে একচেটিয়া পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ ক্রমশঃ পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বগুলোকে সরিয়ে দেবে। আর যুদ্ধও হবে না, কেননা পুঁজিবাদের নিজের বিকাশই জাতিরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা খুইয়ে দেবে। কিন্তু বাস্তবে বিশ্ব বাজারের সর্বশক্তিমানতার সাথে সাথে জাতীয় দ্বন্দ্বগুলো আরও আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে। গত শতাধিক বছরের ইতিহাস হল জাতিরাষ্ট্রের সংকীর্ণ গন্ডিবদ্ধতার বিরুদ্ধে উৎপাদিকা শক্তির বিদ্রোহের ইতিহাস। এপথেই এগিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি— আর তার সাথে বিশ্বসঙ্কট ও বিশ্বযুদ্ধ। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট তাকে বাধ্য করেছে তার নখ-দাঁতকে আরও প্রসারিত করতে। ফলে শুধু ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলোতেই নয়, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতেও সময়ের সাথে সাথে জাতি প্রশ্ন মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়া যাই হোক না কেন, তা ধীরগতির হোক বা বিকৃত, সীমাবদ্ধ— তবু বিভিন্ন জাতি, অগ্রণী থেকে শুরু করে পশ্চাদপদরাও ক্রমান্বয়ে এগিয়েছে, সংহত হয়েছে তাদের আত্মপরিচয় ও বিকাশের আকাঙ্ক্ষাগুলো। ফলে দ্বন্দ্ব নতুন নতুন চেহারায় মাথাচাড়া দিয়েছে। এমনকি সেসব জায়গাতেও এই প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যেখানে এই সমস্যা সমাধান হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়েছিল। বিশ্বের নানা প্রান্তে জাতিদাঙ্গা, জাতি-বর্ণগত ভেদাভেদের অসংখ্য ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করছে।

আমরা যে আলোচনায় ছিলাম, সেই গোর্খাল্যান্ডের দাবির প্রশ্নেও একই কথা সত্যি। যত দিন গেছে, ততই সংহত হয়েছে গোর্খাল্যান্ডের আওয়াজ। পুঁজির ক্রমপ্রসারিত হাত পাহাড়ের মানুষের মধ্যে আরও বেশি বিপন্নতার বোধ তৈরি করেছে, সংহত চেতনা সংগঠিত করেছে অধিকারের প্রশ্নকে। পাশাপাশি ডুয়ার্সের আদিবাসী জনগণের আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষাও আগের তুলনায় অনেক সংহত চেহারায় হাজির হয়েছে এবারের আন্দোলনের পর্যায় জুড়ে। গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলন বেশ খানিকটা অতিবাহিত হওয়ার পরে ক্ষীণভাবে লেপচাদেরও সংগঠিত হওয়ার একটা চেহারা আমরা দেখছিলাম। শাসকদল বা বিরোধীরা, যারা সংসদীয় রাজনীতির মৌতাতে মজে নানারকম জোটবদল বা উস্কানিমূলক কাজে নেমেছে, তাদের ভূমিকা বাদ দিয়ে এখানে কথাটা বলছি। আসলে যত বেড়েছে দেশী-বিদেশী পুঁজিবাদের হাতের নাগাল, ততই অনেকাংশে পিছিয়ে থাকা জাতিগুলোও তাদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে একজোট হতে শুরু করেছে, আওয়াজ তুলেছে তাদের আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে, সেটা বিপন্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে। যত দিন গড়িয়েছে, যত চুঁইয়ে পড়া শিক্ষা-চেতনার আলো গিয়ে পৌঁছেছে একটা জাতির কাছে ততই সেই জাতির অস্মিতা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তাই সময়কালের নিরিখে দেখলে এই রাজ্যেই একের পর এক জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আওয়াজ সমাজের কারান্তরাল থেকে সামনে উঠে এসেছে, ঠিক সেই মাত্রায় যে মাত্রায় সেই জাতি বিকাশের রাস্তায় এগিয়েছে। খণ্ডিত, খর্বিত পুঁজিবাদী বিকাশের এই দেশে এক একটা জাতির বিকাশও খণ্ডিতই থেকেছে, যদি না বিলীন হয়ে গিয়ে থাকে।

আশি পেরিয়ে নব্বই… তারপর…

আমরা ১৯৮৮ তে ঘিসিংয়ের সাথে চুক্তি পর্যন্ত এসে আলোচনাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছিলাম। তত্ত্বের ধূসরতা ছেড়ে এবার আবার ফেরা যাক জীবনের সবুজে। ১৯৮৬–র আন্দোলনের পর্বটা পাহাড়ের বুকে এক দগদগে ক্ষতের মত। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে ইতিহাসে সেই প্রথমবার ব্যাপক মানুষের জমায়েত হতে শুরু করল মিটিং-মিছিলে। কালিম্পং-কার্শিয়াংয়ে গুলিচালনার ঘটনা, সরকারের দিক থেকে বিবিধ রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতিবাদে আরও আরও মানুষ গণআন্দোলনে সামিল হতে থাকলে এই আন্দোলনকে ‘দেশবিরোধী’ তকমা লাগানোর চেষ্টা চলে সরকারের তরফে। অন্যদিকে অনেকের অভিযোগ যে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার সুবাস ঘিসিংকে বামফ্রন্ট বিরোধী চক্রান্ত করার জন্য তাদের দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। সরকারের গোয়েন্দা দফতরের লোকজনের সাথে সুবাস ঘিসিংয়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অনেক প্রামাণ্য তথ্যের কথা বলেন তারা। যাই হোক, অভিযোগ–পাল্টা অভিযোগে যা শোনা যায় তাতে ১২০০ জিএনএলএফ সমর্থক ও ২০০ সিপিএম সমর্থক খুন হন। এসবের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের মানুষের মনে গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্ন গভীরে প্রোথিত হয়, কিন্তু ঘিসিং গোর্খাল্যান্ডের দাবী ছেড়ে দিচ্ছে বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯৮৮ তে দার্জিলিং পার্বত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠার চুক্তি করে সরকারের সাথে। সুবাস ঘিসিং হন সেই পার্বত্য পরিষদের চেয়ারম্যান। এর পরের পর্বটা ভয়াবহ স্বৈরাচারের, স্বজনপোষণ আর দুর্নীতির— রাজ্য সরকারও যাকে মদত দিয়ে চলে। কোন নির্বাচনে সিপিএমকে সমর্থন, কোনটাতে বয়কট, কোনটাতে কংগ্রেসকে সমর্থনের মধ্যে দিয়ে, এবং কন্ট্রাক্টররাজ কায়েম করে ঘিসিং মোটের ওপর তার ও তার দলের দলতন্ত্র স্থাপন করেন।

১৯৯২ তে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সংবিধানে নেপালি ভাষা স্বীকৃতি আদায় করে। প্রায় ৩৬ বছর ধরে চলে আসা এই ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে সংগ্রাম শেষ পর্বে এসে সংসদে এরকম অভিযোগ পর্যন্ত শোনে যে নেপালি ভাষা একটা বিদেশী ভাষা, একে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না। আশ্চর্যের ব্যাপার যে তৎকালীন দার্জিলিংয়ের সাংসদ জিএনএলএফের সমর্থনে জেতা কংগ্রেসের ইন্দ্রজিত খুল্লার সংসদে এই মন্তব্য করেন। কিন্তু দার্জিলিংয়ে এই নিয়ে আন্দোলন জোরালো হতে থাকে, অবশেষে ২০ আগস্ট, ১৯৯২-এ কোঙ্কনি ও মনিপুরী ভাষার সাথে নেপালিও স্বীকৃত হয়।

সেই ভাষার স্বীকৃতির লড়াইয়ে যেমন জিএনএলএফের ভূমিকা ভালো ছিল না, তেমনই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বদলে অদ্ভুতভাবে একস্তর পঞ্চায়েত চালানো, স্কুল সার্ভিস, কলেজ সার্ভিস সহ বিভিন্ন চাকরির ব্যবস্থা অকেজো হয়ে থাকা সহ অসংখ্য অদ্ভুত সব পদক্ষেপ, বহু ক্ষেত্রে সীমাহীন খামখেয়ালিপনার ফলে বিরোধী মত ধূমায়িত হতে থাকে। ওদিকে সিপিএমের ভিতরেও কিন্তু ক্রমশ বিরোধিতা জমছিলো। ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে পাহাড়ের সিপিএম প্রায় পুরোটাই ভেঙে যায়। দার্জিলিং জেলা কমিটির ৪২ জন সদস্যের ২৯ জন ছিলেন পাহাড়ের। তাদের মধ্যে ২৫ জন সিপিএম ছেড়ে দেন, গড়ে ওঠে নতুন দল সিপিআরএম (কম্যুনিস্ট পার্টি অফ রেভলিউশনারি মার্কসিস্টস)। জাতিসত্তার প্রশ্নে সিপিএমের দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত— এই অভিযোগ তুলে তারা গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে তুলতে থাকেন। সিপিএমের সাথে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও, সিপিএমের সামগ্রিক শোধনবাদী রাজনীতির নিরিখে তারা অবশ্য কোন স্পষ্ট ভিন্ন অবস্থান হাজির করেনি। সিপিএমের ক্ষেত্রে যেমন বড় জাতির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের প্রভাব প্রকট, এই নতুন গড়ে ওঠা সিপিআরএমের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে নিপীড়িত জাতির জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ। পরিস্থিতির প্রতিকূলতা নিশ্চয়ই ছিল, এখনো আছে— কিন্তু তাদের বাস্তব কার্যক্রমে শ্রেণির লড়াইকে ছাপিয়ে বারম্বার বেশি দেখা গেছে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে দাবিদাওয়ার প্রাধান্য। ফলে একদা বামপন্থী আন্দোলনের জোরালো ভিত্তি গড়ে উঠেছিল যে দার্জিলিংয়ে, সেখানে দমনকারী জাতি ও অবদমিত জাতির বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের যে বিপদ সম্পর্কে মার্কসবাদের শিক্ষকরা বারবার সতর্ক করেছেন, অনেকটাই সেই বিচ্যুতিগুলোর শিকার হল বামপন্থী পরিচয়ের এই দলগুলো। সিপিএমের কারণে বামপন্থার প্রতি জনগণের যে বিশ্বাসভঙ্গ হয়েছে, তা মেহনতি মানুষবহুল এরকম একটা অঞ্চলে শ্রেণি রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটাকেই কঠিন করে তুলেছে।

ঘিসিং-এর একচ্ছত্র জমানা চলতে চলতে ২০০৪-এ পর্ষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ঘিসিং নানা অজুহাতে নির্বাচন পেছোতে থাকে। সরকারও তাকে কেয়ারটেকার প্রশাসক বানিয়ে দেয়। তারমধ্যে ঘিসিং দাবী তোলে যে নির্বাচন হবে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির পর, যা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন জনজাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষাগুলোকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৈরি হয়েছে। সরকারও ২০০৫-এ ঘিসিংয়ের এই দাবির কাছে নতিস্বীকার করে। নতুন সমঝোতা অনুসারে পর্ষদের ৩১% সিট সংরক্ষিত হবে উপজাতিদের জন্য, গোর্খারা সেই উপজাতিদের তালিকায় নেই। আর ঘিসিং নিজে যে তামাং উপজাতির, সেটা ঠিক ২০০৫-এই ঐ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। পাহাড়কে এই ধরণের বিভিন্ন উপজাতি প্রধান এলাকা হিসেবে দেখানোর জন্য ঘিসিং পাহাড়ে অদ্ভুত সব ফরমান জারি করতে থাকেন। মূর্তি পুজোর বদলে শিলাপুজো, বিভিন্ন রকম তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুঁককে মদত দেওয়া বাড়তে থাকে। একদিকে দেশী-বিদেশী পুঁজির বাড়তে থাকা প্রভাব, তার সংস্কৃতি, এনলাইটেনমেন্ট আর পুঁজির সেই শোষণকে নগ্নভাবে চিনতে শুরু করা মানুষজনের কাছে এই সব পিছিয়ে পড়া ভাবনা বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। শেষপর্যন্ত ফেটে পড়ে মানুষের বিক্ষোভ।

২০০৭-এ নতুন আন্দোলন

গোর্খা জাতীয়তাবাদের স্লোগানকে এবার তুলে ধরে অবতীর্ণ হয় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নামক দলটি। ২০০৭-এর নভেম্বরে। নতুন করে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে এবার শুরুতে দেখা গেল অনেক বুদ্ধিজীবীদের, দেখা গেল নাগরিক সমাজ বলা যায় এমন একটা অংশকেও। এবং ঘিসিংয়ের পুরো সমর্থকবাহিনী, কন্ট্রাক্টর, রাজনৈতিক নেতারা, গাঁ-বস্তি-বাজারের মাতব্বররা যোগ দিল বিমল গুরুংদের সাথে। আন্দোলন শুরুর কিছু পরেই বাতিল হয়ে গেল ষষ্ঠ তফশিলে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব। তারপর প্রায় তিন-সাড়ে তিন বছরের পর্ব… অনেক উথালপাথাল, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, বিবাদ-বিরোধ-হত্যাকাণ্ড, অবরোধ-বনধ-বয়কটের রাজনীতির পর চুক্তি সই হল। এই গোটা পর্বটাতে একবার শুধু দার্জিলিংয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় গোর্খা লিগ নেতা মদন তামাংয়ের হত্যার ঘটনায় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার জনপ্রিয়তায় খানিক ভাটা পড়েছিল। তা বাদে পাহাড়ের মানুষের দিক থেকে তাদের প্রতি সমর্থনই সাধারণভাবে থেকেছে। ইদানীং ক্ষমতায় বসার পর অবশ্য ইতিউতি জনগণের বঞ্চনা জনিত ক্ষোভও দেখা যাচ্ছিল। জনগণের এবং ভোটের রাজনীতির চাপে, এবং রাজ্য সরকারের ক্রমশঃ নখ-দাঁত বের হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হয়তবা এখন আবার তাদের নতুন করে দাবিদাওয়ার সোচ্চার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।

যে চুক্তি সই হয়েছে, তাতে বর্ধিত স্বশাসন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গোর্খাল্যান্ড হয়নি। অন্যদিকে নানা ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ায় গত দু-তিন বছরে ডুয়ার্সের আদিবাসীরা সংগঠিত হয়েছেন। প্রথমে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের বিরোধিতাই তাদের সংগঠিত হওয়ার প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করছিলো। পরে চা বাগানের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে তারা রাস্তায় নামতে থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ হল, একটা জাতিসত্তার নবজায়মান প্রকাশ হিসেবে ডুয়ার্সের চা বাগানের আদিবাসীদের প্রথমবারের জন্য এই সংগঠিত চেহারাটা। দু’দশক আগে এই ছবিটা অনুপস্থিত ছিল। তারা ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলছে এখন। সংসদীয় রাজনীতির আবর্তে পড়ে এখানেও অবশ্য বিভাজন হয়েছে, এবং নিপীড়িত জাতিসত্ত্বা হিসেবে সংগঠিত হওয়ার ঘটনাপ্রবাহ ক্রমশঃ দলাদলি ও পেশিশক্তির আস্ফালনে পর্যবসিত হয়েছে। শাসকরা সফলও হয়েছে এই বিভাজন ও উপঢৌকনের রাজনীতির পন্থা নিয়ে। উত্তরবঙ্গে পৃথক রাজ্যের দাবিতে বা নিপীড়িত জাতিসত্তার আন্দোলন অনেকগুলো রয়েছে। কামতাপুর বা গ্রেটার কোচবিহারের আন্দোলন এক পুরনো সামন্ততান্ত্রিক যুগের ইতিহাসকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা, দীর্ঘ বঞ্চনা তাতে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে। কিন্তু পাহাড়ের গোর্খাদের আন্দোলনের দাবী কিন্তু ক্রমশ নিপীড়িত জাতিসত্তার সংগঠিত হওয়ার সাথে সাথে মাত্রাগতভাবে বেড়েছে। অভিমুখটা খেয়াল করুন। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের দাবির মুখে দাঁড়িয়ে পাহাড়ে এরকম পর্ষদজাতীয় কিছু তৈরি হয়েছে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানায় প্রথমবার, তারপর ৮৮তে, তারপর হল আবার এবার। এবং লক্ষ্য করার মত বিষয় হল প্রত্যেকবারই যে পর্ষদ তৈরি হয়েছে, তার স্বশাসনের মাত্রাটা আগের চাইতে বেশি। অর্থাৎ একটা জাতিসত্তা যত বিকশিত হয়, তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাও ততই বাড়ে, এবং আগের অধিকারটুকু তখন নিতান্ত কম বলে মনে হয়।

পুঁজির অগ্রগতি… জাতির মুক্তির প্রশ্ন

এখন প্রশ্ন হল, যে জিটিএ চুক্তি হয়েছে তাতে কার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে? চুক্তি অনুযায়ী অনেক প্রশাসনিক, কর্মসংস্থানবিষয়ক, শিক্ষাগত সহ বিভিন্ন প্রশ্নে অধিকার সমর্পিত হয়েছে জিটিএ-র হাতে। এবং ঘিসিংয়ের পর্ষদ যেখানে চব্বিশ কোটি টাকা পেয়েছিল, জিটিএ সেখানে পাবে আপাতত বছরে ২০০ কোটি করে, তিন বছরের জন্য। আরও অনেক ‘উন্নয়নের’ পরিকল্পনার সাথে আছে ঐ অঞ্চলে এসইজেড তৈরির কথা বা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল তৈরির কথা। অর্থাৎ আর শুধু টি-টিম্বার-ট্যুরিজম এর স্বল্পতম ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ আর মুনাফা করা নয়, এবার পুঁজির মালিকদের জন্য সুখবর, তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র আরও ব্যাপ্ত হতে চলেছে। দেশী-বিদেশী পুঁজি যে পাহাড়ে আরও কিছু পুঁজিপতির জন্ম দেবে সন্দেহ নেই, সন্দেহ নেই যে শোষণের ক্ষেত্র আরও ব্যাপ্ত হবে। কিন্তু মুশকিল হল, যে শ্রমিকরা এই গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলনে নিজেদের ঢেলে দিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের সমস্যার মৌলিক কোন সমাধান হবে না। অন্যদিকে অবদমিত জাতিসত্তা হিসেবে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাটা পাহাড়ের সমাজের বিকাশ যত হতে থাকবে, তত বাড়তেই থাকবে। জিটিএ-র চুক্তির শর্ত আর উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো স্পষ্টতই সেদিকে দিকনির্দেশ করছে। তো এই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বারেবারেই আগেরবারের তুলনায় আরো জোরের সাথে রাজ্যের দাবিকে হাজির করতে থাকে। এপথে হয়ত কখনো রাজ্য গঠনও হবে, কিন্তু সমস্যা থেকে কি মুক্তি ঘটবে? এরকম কোনো সমাধানের মধ্যে দিয়ে আরো পিছিয়ে থাকা কোনো জাতি যখন সংহতভাবে তার দাবীদাওয়াকে ক্রমশঃ জোরালো করতে থাকে, শাসকরা যাকে বলে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাওয়া, তখন সেই সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে? এভাবে একটা রাজ্য, একটা গোর্খা পার্বত্য পরিষদ, একটা লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ— যাই হোক না কেন, সমস্যার কি চূড়ান্ত সমাধান হয়? যারা এভাবেই চূড়ান্ত সমাধান দেখে বা দেখায়, তাদের সামনে উদাহরণ আছে উত্তরাখণ্ড, ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ডের— সেখানকার মানুষের কি মুক্তি ঘটেছে? সমগ্র দেশ-বিশ্বের বিচারে মুক্তি ঘটেছে কি ঐ জাতিসত্তাগুলোর? শ্রমজীবী-গরিব মানুষের মুক্তির কথা তো অনেক পরের ব্যাপার।

তাহলে এটা স্পষ্ট যে পরিমাণগতভাবে এই ক্রমবর্ধমান স্বশাসনের উপঢৌকন গুণগতভাবে একটা জাতির মুক্তির আস্বাদে পরিণত হবে না। জাতির চূড়ান্ত মুক্তির প্রশ্নটা সেকারণেই সমাজে শ্রেণিশোষণের অবসানের সাথে সম্পর্কিত। পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে মুনাফা লোটার আরও অনেক বন্দোবস্তের মধ্যে একটি অবশ্যই অসম বিনিময়— পিছিয়ে থাকা জাতির পিছিয়ে থাকা চেতনা, অসহায়তা, আর ব্যাপক কর্মহীনতার সমস্যার ওপরে দাঁড়িয়ে যা চলতে থাকে। কিন্তু পুঁজিবাদী বিকাশের আজকের পর্বে, যেখানে দেশী-বিদেশী পুঁজি অনেক গভীরতা ও ব্যাপ্তি নিয়ে ঢুকে পড়ছে সমস্ত অঞ্চলে, সেখানে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাধারণভাবে যতটা থাকে, তার চেয়ে বেশি শ্রেণি প্রশ্নে ঝোঁক থাকা জরুরি বলে মনে হয়। পুঁজিবাদের শুরুর যুগে যেভাবে ভাবা গেছিল যে নানারকম ফারাককে ঘুচিয়ে দিয়ে সে শুধু তৈরি করবে মুক্ত শ্রমিক, দেখা গেল যে, পরবর্তীতে থমকে যাওয়া বা নিজের রাশ টেনে ধরা পুঁজিবাদ তার নিজস্ব গতিতে এসব পার্থক্যকে ঘুঁচিয়ে দিল না। ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের শুরুর যুগে এমন হয়েছিল যে ক্রমপ্রসারমান পুঁজিবাদ ছোট ছোট জাতীয় গণ্ডিকে ভেঙ্গে ফেলছিল, এবং ক্রমশ একীকরণের মধ্যে দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন বড় বড় জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। নিজস্ব জাতীয় বৈশিষ্ট্য সহ এই ধরনের সমষ্টিগুলোর বৃহত্তর জাতির মধ্যে একীভূত হওয়া এই জাতিগুলিকে এঙ্গেলস বলেছিলেন অনৈতিহাসিক বা অ-সম্ভব জাতি। এখন যদি সচেতন বামপন্থী আন্দোলনের ভূমিকা না থাকে, তাহলে আর এই প্রক্রিয়াটা সম্ভব নয়। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, যেখানে পুঁজিবাদ নিজে এক বিকৃত ও খণ্ডিত-খর্বিত ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে বরং এই সমষ্টিগুলো, যাকে এঙ্গেলস অনৈতিহাসিক বলেছেন, তার দিক থেকে উল্টো চেষ্টাটাই থাকবে, পৃথক পৃথক জাতিগত সমষ্টিতে কেলাসীভূত হওয়া, এবং বড় জাতির সাথে জুড়ে যে জাতিগত পরিচয়ে তারা নড়বড়ে ভাবে থাকছিল, সেখান থেকে বিচ্ছিন্নতাই তারা দাবি করবে। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এই প্রবণতা আরও বেশি থাকবে। সেখানে বামপন্থী আন্দোলন জোরদার না থাকলে শ্যভিনিজমের প্রকাশ আরও বেশি হতে পারে, লেনিন যেভাবে বলেছিলেন যে, “নিপীড়িত জাতির মধ্যে জাতি প্রশ্নে সুবিধাবাদের প্রকাশ অবশ্যই দমনকারী জাতির মধ্যে যেমন, তার তুলনায় জোরালো হতে থাকবে”। কিন্তু তা বলে তো সেই আন্দোলনের ঐতিহাসিক অনিবার্যতাকে অস্বীকার করা যায় না। জাতি গঠনের চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে তাকে দেখতে হবে, এবং সেই অবস্থায় সংগ্রামকে বিকশিত করতে হবে। এবং সেই জাতির অগ্রগতির, চূড়ান্ত মুক্তির রাস্তা জোড়া রয়েছে শ্রেণিহীন সমাজের গঠনের লড়াইয়ের সাথে।

Leave a comment